"চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন" - কোনো বাঙালিকে দ্বিতীয় বার আর মনে করাতে হবে না। প্রত্যেক বাঙালির তথা ভারতবাসীর হৃদয়ে চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা আছে ও থাকবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই উজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা। আর এই চট্টগ্ৰাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে মাষ্টারদা সূর্যসেনের ডানহাত বা প্রধান সহকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন অগ্নিযুগের এক কাণ্ডারি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। মাষ্টারদা সূর্যসেনের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি, বিপ্লবী গণেশ ঘোষ আজীবন যিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্ৰাম চালিয়ে গেছেন।
তাঁর জন্ম হয় অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার বিনোদপুরে। বাবা বিপিন বিহারী ঘোষ ছিলেন রেল কর্মচারী। তাঁর কর্মস্থল ছিল চট্টগ্ৰাম। কিশোর গণেশের স্কুল জীবন কেটেছিল চট্টগ্ৰামে। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিং যে অনন্ত সিং এর সঙ্গে মাষ্টারদা সূর্যসেনের যোগাযোগ ছিল। মাষ্টারদার সঙ্গে গণেশের পরিচয় করিয়ে দেন অনন্ত সিং-ই। মাষ্টারদার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে এরপর তিনিও বিপ্লবী দলে যোগ দিলেন।
১৯২১ সালে সারা দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। গণেশ চন্দ্রও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারা চট্টগ্ৰাম জুড়ে স্কুল কলেজ বয়কটে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রামের বাংলা অয়েল কোম্পানির ধর্মঘট, স্টিমার কোম্পানির ধর্মঘট, রেল ধর্মঘট ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দেন।
অত্যন্ত মেধাবী গণেশ চন্দ্র স্কুলের পড়া শেষ করার পর তিনি পুরোপুরি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু সূর্য সেনের আদেশে কলকাতায় এসে ১৯২২ সালে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন। এখানে পড়তে পড়তেই ১৯২৩ সালে বোমা বানানোর অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্ৰেফতার করে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সঠিক প্রমাণ না পাওয়ায় তিনি ছাড়া পেয়ে যান। মাষ্টারদা সূর্যসেন যখন তার অনুগামীদের নিয়ে যুগান্তর দল গঠন করেন, এই দলের অন্যতম সদস্য করেছিলেন গণেশ ঘোষকে।
১৯২৪ সালের পর থেকে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে স্বাধীনতার দাবিতে। ধীরে ধীরে সর্বত্র বিপ্লবীরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন সশস্ত্র সংগ্ৰাম এবং আক্রমণের জন্য। এই সময় "ভারত রক্ষা আইন" নামক আইনে গ্ৰেফতার হন গণেশ ঘোষ। চার বছর জেলে বন্দী থাকার পর ১৯২৮-এ মুক্তি পান তিনি।
কিন্তু এই অগ্নিশিখাকে নিভিয়ে দেওয়া কি অত্যাচারী ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা সম্ভব? তিনি জেল থেকে বেরিয়েই যোগাযোগ করেন মাষ্টারদা সূর্যসেনের সঙ্গে। গণেশ চন্দ্র এবং অনন্ত সিং এর প্রচেষ্টায় চট্টগ্ৰামে ছাত্র, যুবক ও নারীদের নিয়ে এক জনসংগঠন গড়ে ওঠে। অন্যদিকে সূর্য সেন গণেশ চন্দ্র সহ আরো চারজন বিপ্লবীকে নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাষ্টারদা সূর্যসেনের দলের নাম রাখা হয় "ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি" চট্টগ্ৰাম শাখা। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের এক দুরন্ত দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নেয় এই বিপ্লবী পরিষদ। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এক বিরাট বিপ্লবী দল তৈরি করেন তাঁরা। নিয়মিত শরীরচর্চা, অস্ত্রচালনা শিক্ষা চলতে থাকে এবং পাশাপাশি অস্ত্র যোগাড়ের চেষ্টা এবং বোমা তৈরিও চলে।
তারপর আসে সেই দিন। গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল তরুণ বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই সেই উজ্জ্বল অধ্যায় ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে যে ঘটনা "চট্টগ্ৰাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন" নামে বিখ্যাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদ কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বিপ্লবীরা সফল ভাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। ভোর হওয়ার আগেই বিপ্লবী দল পুলিশ অস্ত্রাগারে জড়ো হয় এবং মাষ্টারদা সূর্যসেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মোট পঁয়ষট্টি জন বিপ্লবী এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।
গণেশ চন্দ্র ঘোষ এরপরে ব্রিটিশ ফৌজের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়ে তিনবার জয়লাভ করেন এবং একবার সাংসদ হন। আমৃত্যু অতি সাধারণ জীবনযাপন করা এবং মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া এই মহান বিপ্লবী ১৯৯২ খ্রীষ্টাব্দে ২২শে ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।
স্বাধীনতার ইতিহাসে ভারতমাতার এই উজ্জ্বল সন্তানের নাম চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।