হৃষিকেশ মুখার্জি: বহুমুখী প্রতিভার রূপ-কথা

সালটা ১৯৪৫। বি এন সরকারের 'নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও' তখন সিনেমা তৈরির বিরাট প্রতিষ্ঠান। মাস মাইনের নামিদামি চিত্রপরিচালক, নামজাদা চিত্রনাট্য লেখক, উঁচুদরের সঙ্গীত পরিচালক, বড় বড় সব অভিনেতা-অভিনেত্রী, নিজস্ব ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান, এডিটার, এডিট সেটআপ, আর্ট ডিরেক্টর, ফিল্ম প্রসেসিং ল্যাব প্রভৃতি সিনেমা তৈরি ও তার প্রচার-প্রসারের জন্য যা যা লাগে সব ছিল এই প্রতিষ্ঠানের তাঁবেতে।

তখন তো সিনেমা শেখার স্কুল ছিল না। নিউথিয়েটার্সস্টুডিওর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোই সে-সময় সিনেমার কাজ শেখার জন্য ছিল একেবারে আদর্শ জায়গা।

ফলে, এই সময়ই একদিন বিজ্ঞান-শিক্ষিত যুবক হৃষীকেশ মুখার্জি ক্যামেরাম্যান হবার স্বপ্ন নিয়ে এখানকার প্রসেসিং ল্যাবে যোগ দিলেন। গোড়া থেকে শেখার জন্য এটাই ছিল প্রথম ধাপ।

পরিচালকদের পরিচালক বিমল রায় তখন নিউ থিয়েটার্সে। তাঁর একখানা ছবির এডিটিং চলছে। কিন্তু এডিটার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ চালাচ্ছেন এসিস্ট্যান্ট এডিটার।

কিন্তু একা সব কাজ করতে গিয়ে এসিস্ট্যান্ট এডিটার অচিরেই পড়লেন মহামুশকিলে। দেখা গেল, তাঁর একখানা এসিস্ট্যান্ট না-হলে কাজ আর এগোচ্ছে না মোটেই। এদিকে মাস-মাইনের এই প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে দুম করে কাউকে এনে কাজ উদ্ধার করানোও যায় না! এখন উপায়?

জোড়াতালি দেওয়া থেকে বাঁচতে তখন পড়ে রইল একটিই উপায়। সেটি হচ্ছে স্টুডিওরই কাউকে অনুরোধ-উপরোধ করে কাজে লাগানো। ফলে, সেই এসিস্ট্যান্ট এডিটারটি ফিল্ম প্রসেসিং ইউনিটের ভালো মানুষ হৃষীকেশকেই গিয়ে ধরলেন : ভাই, ম্যানেজ করে একটু সাহায্য না-করলে যে কাজ উদ্ধার হয় না!

তখন কী আর করা, নিজের ইউনিটের অনুমতি নিয়ে হৃষীকেশ সেই উদ্ধার-কাজে ব্রতী হলেন।

'মুভিঅলা'-নামের একটি মেশিনে ফিল্ম চালিয়ে বিদ্দাটাক স্ক্রিনে নেগেটিভ ছবি দেখে দেখে সেকালের এডিটারদের এডিট করতে হত। হৃষীকেশের কাজ হল, সেই মেশিনে শট মিলিয়ে ফিল্মের প্রয়োজনীয় স্পুলটি চালানো, চালানো হয়ে গেলে ফিল্ম গুটিয়ে স্পুলটি ঠিক জায়গায় রাখা, ফিল্ম জোড়া দেওয়ার জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেদিন এডিটিং চলছে। বিমল রায় সেই সময় হাজির রয়েছেন। মুশকিলটাও হল ঠিক তখনই। তাঁর সামনে ছবির সঙ্গে ডায়লগ সিঙ্ক করতে না-পেরে এসিস্ট্যান্ট এডিটারের গলদঘর্ম অবস্থা হল।

আসলে, সেই যুগে এডিটিং, শ্যুটিং সমস্ত বিষয়টাই বড্ড জটিল ছিল। কারণ, শ্যুটিং-এর সময় ছবি এবং সাউন্ড আলাদা আলাদা ফিল্মে তুলতে হত। এডিট টেবিলে দুটোকে একসঙ্গে মেলাতে হত। সেই মেলানোর আবার অঙ্ক ছিল, অঙ্কে ভুল হলে কিছুতেই মিলত না।

তা, সেদিন অঙ্কে কোথাও একটা ভুল হচ্ছিল, তাই মিলছিল না। মনোযোগ দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে দেখতে হৃষীকেশ একসময় ভুলটা বুঝতে পারলেন। সেটা ধরিয়েও দিলেন। এবং, সেভাবেই ছবি ও ডায়লগ সুন্দরভাবে ম্যাচ করে গেল।

আর এই ঘটনাটি ঘটতেই হৃষীকেশের দিকে ঝটিতে তাকালেন বিমল রায়। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছোকরা এসে এডিটারের ভুল ধরিয়ে দিল! তিনি অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝলে কী করে?

হৃষীকেশ সলজ্জ হেসে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আমি যে খুব বুঝে বলেছি, ব্যাপারটা এমন নয় স্যার; আমার শুধু মনে হল যে, ওভাবে হয়তো সিঙ্ক করতে পারে, তাই...

বিমল রায় নিজে গুণী মানুষ। গুণী মানুষের কদর করতে জানেন। হৃষীকেশকে তাঁর ভালো লাগল। কেননা, তিনি বুঝে গেছেন যে, ছোকরাকে দিয়ে হবে, ছোকরার মাথা পরিষ্কার।

ব্যস, তিনিই উদ্যোগ নিয়ে হৃষীকেশকে ফিল্ম প্রসেসিং ইউনিট থেকে টেনে এনে এডিটিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষানবিশ করে দিলেন।

মাস চারেক যেতে-না-যেতেই আর-একটি ঘটনা ঘটল:

বিমল রায়েরই আর একটি ছবি। সেই ছবির এডিটিং কমপ্লিট। স্ক্রিনিং করে বি এন সরকার মশাইকে দেখানো হল। ছবিতে পর পর দুটি গান ছিল। তাদের মাঝখানে কোন সিন ছিল না। এটা সরকারমশাইয়ের পছন্দ হল না। তিনি বললেন দু'খানা গানের মুড অনুযায়ী এক বা দু'খানা সিন লিখিয়ে শ্যুট করে মধ্যিখানে বসিয়ে দিতে।

সুতরাং, শুরু হয়ে গেল শ্যুটিং-এর তোড়জোড়। কিন্তু তাতে বাধা দিলেন ঋষিকেশ। তিনি বিমল রায়কে বললেন যে, শ্যুট না-করেও সমাধান সম্ভব। বিমল রায় বললেন, কীভাবে? হৃষীকেশ বললেন, রি-এরেঞ্জ করে। বিমলবাবু বললেন, বেশ, করো তো দেখি...

ব্যস, হৃষীকেশ কাজে লেগে গেলেন। গানের পরের একখানা সিন তুলে এনে সিকোয়েন্সটা রি-এডিট করে দুই গানের মধ্যিখানে এমনভাবে রিপ্লেস করে দিলেন যে, কন্টিন্যুইটির কোন সমস্যা তো হলই না; উল্টে দুটো গানের মধ্যে একটা ব্রিজ তৈরি হয়ে সিকোয়েন্সটা সরকারমশাই যেমন চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনই সুন্দর হয়ে উঠল। তাই দেখে সকলেই খুব খুশি হলেন।

বিমলবাবু আর দেরি করলেন না। প্রতিভাকে যোগ্য সম্মান দিতে নিউ থিয়েটার্স-এর নভিশের জীবন থেকে বের করে এনে হৃষীকেশকে ফিল্মের পুরোদস্তুর ও স্বাধীন সম্পাদক করে দিলেন।

বিমল রায় তখন 'দাদা' হয়ে গেছেন। তাই হৃষীকেশ শুরুটায় অবশ্য মৃদু আপত্তি করে বলার সুযোগ পেয়েছিলেন, দাদা, আমি যে এখনও নভিশ...। উত্তরে বিমলবাবু বলেছিলেন, তোমার ওপর আমার পুরো ভরসা আছে, নিজের ওপর তোমার ভরসা আছে তো?

উত্তরের আর প্রত্যুত্তর দেবার মতো ফাঁক ছিল না। ফলে, ১৯৫০ সাল নাগাদ হৃষীকেশ স্বাধীন সম্পাদক হয়ে উঠলেন। তাঁর সেই প্রথম সম্পাদিত ছবির নাম, 'তথাপি'। ছবির পরিচালক, মনোজ ভট্টাচার্য।

ছবিটি সম্পাদনা করে হৃষীকেশ বিমল রায়ের মুখ উজ্জ্বল তো করলেনই, সেই সঙ্গে সিনেমা জগতের তাবৎ মানুষের কাছে সম্পাদক হিসেবেও বেশ নাম করলেন।

বিমল রায় মস্ত বড় জহুরী ছিলেন বলেই মাত্র মাস চারেকের শিক্ষানবিশের ওপর অন্যের ছবির দায়িত্ব দিতে পেরেছিলেন। অন্য কারও পক্ষে এমনটা ভাবাই সম্ভব ছিল না। আবার উল্টো দিকে, হৃষীকেশ সত্যিকারের হিরে ছিলেন বলেই নিজের ও বিমলবাবুর মুখরক্ষা করতে পেরেছিলেন।

বাইরের জগতে জায়গা করে দিয়েও বিমলবাবু হৃষীকেশের হাত ছাড়লেন না। নিজের ছবির এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টার ও এডিটার করে ১৯৫১-য় তাঁকে সঙ্গে করে বম্বে নিয়ে এলেন। হাতে ধরে স্ক্রিপ্ট রাইটিং শেখালেন। ফলে, তাঁর 'মা' (১৯৫২), 'দো বিঘা জমিন' (১৯৫৩) প্রভৃতি ছবিতে হৃষীকেশকে একইসঙ্গে স্ক্রিপ্ট রাইটার, এডিটার এবং চিফ এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টার--এই তিনটি ভূমিকায় দেখা গেল।

১৯৫৫। 'দেবদাস' ছবির শ্যুটিং চলছে। দিলীপ কুমার নায়ক। ততদিনে একজন টেকনিশিয়ান এবং মানুষ হিসেবে হৃষীকেশ তাঁর খুব পছন্দের হয়ে উঠেছেন। একদিন মোহন স্টুডিওর বাইরে দুজনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দুজনে। হঠাৎ দিলীপ কুমার বললেন, তোমাকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম-ডিরেক্টার হিসেবে দেখতে চাই। তার জন্য যদি বিনিপয়সায় কাজ করতে হয়, নির্দ্বিধায় বলো, আমি করব...

১৯৫৬'য় সেই স্বাধীন চিত্রপরিচালক হওয়ার সুযোগ পেলেন হৃষীকেশ। বিমল রায়ের আর-এক শিষ্য ঋত্বিককুমারঘটক ছবির জন্য গল্প লিখে দিলেন। অন্যরকমের গল্প। একটি নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে বিভিন্ন সময়ে আসা চার ভাড়াটের জীবনে ঘটা মোড় ঘোরানো ঘটনা এই ছবির উপজীব্য। এই চার ভাড়াটের ভূমিকায় অভিনয় করলেন : দিলীপ কুমার, কিশোর কুমার, সুচিত্রা সেন, নিরূপা রায়। ছবির নাম, 'মুসাফির'। রিলিজ করল, ১৯৫৭'য়।

ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্য না-পেলেও চলচ্চিত্র-জগতে ভিন্ন ধারার পরিচালক হিসেবে বেশ পরিচিতি পেলেন হৃষীকেশ। শিল্প-সিনেমা ও জনপ্রিয়-সিনেমার বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে বিমল রায় যে তৃতীয় ধারাটির সূচনা করেছিলেন, সেই ভিন্ন ধারাটিকে অন্য মাত্রা দিলেন হৃষীকেশ।

প্রথম ছবি সাফল্য না-পেলেও দ্বিতীয় ছবি 'আনাড়ি' (১৯৫৯) থেকে হৃষীকেশ রাজপথে জোরকদমে বিজয়রথ হাঁকালেন। ছবিটি সে-বছর ছ'খানা পুরস্কার জিতে নিল।

তারপর আর কী, 'সত্যকাম', 'আনন্দ', 'গুড্ডি', 'চুপকে চুপকে', 'গোলমাল', 'নরম গরম', 'অভিমান' ,'খুবসুরত' প্রভৃতি ছবির মধ্য দিয়ে আরও প্রায় পঁয়ত্রিশটি বছর ধরে সর্ব-ভারতীয় ছবির দর্শকদের মজিয়ে রাখলেন; হয়ে উঠলেন সবার প্রিয়, 'ঋষিদা'।

শুধু তাই নয়, নিজের মুন্সিয়ানায় হৃষীকেশ গুরুকৃত ভিন্ন ধারার পথটিকে আরও মজবুত করলেন, ভারতীয় সিনেমাকে প্রবলভাবে পরিবারমুখী করলেন, বক্তব্যকে মজায় মুড়ে মনোরঞ্জক করলেন, মনোরঞ্জন করেও দর্শকের মনে দাগ রাখতে সমর্থ হলেন, সমসময়েই অজস্র উত্তরসূরি তৈরি করলেন। শিল্পের ইতিহাসে এ-বড় কম কথা নয়। তাই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে, ভিন্ন ধারার প্রবহমানতায় হৃষীকেশ মুখার্জি আজও একটি বিশিষ্ট ও অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...