যে বছর দেশ স্বাধীন হল, সেই ১৯৪৭ সালেই বাংলা চলচ্চিত্রের 'সুরকার' হিসেবে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হল। পিঠোপিঠি দুটি ছবিতে। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'পূর্বরাগ' এবং হেমেন গুপ্ত পরিচালিত 'অভিযাত্রী'-তে। এই দুই ছবির অভাবনীয় সাফল্যে হাতে আসতে লাগল একের পর এক ছবি : 'ভুলি নাই', 'সন্দীপন পাঠশালা', 'বিয়াল্লিশ' প্রভৃতি। তারই মধ্যে ডাক এলো বম্বে থেকে। ডাকলেন বিখ্যাত পরিচালক, ভি শান্তারাম। তিনি 'শিবশক্তি'-নামে একটি ছবি করবেন, তাতে সুর দিতে হবে হেমন্তকে। হেমন্ত বম্বে গেলেন বটে, কিন্তু, শেষমেশ ছবিটা হল না। সুতরাং, প্রথম ডাকটি যেন ফাঁকা-ডাকই হয়ে গেল।
দ্বিতীয়বার ডাক দিলেন 'অভিযাত্রী' ছবির পরিচালক। হেমেন গুপ্ত। বম্বের বিখ্যাত 'ফিল্মিস্থান স্টুডিও' হেমেনকে ডেকেছে। কারণ, হেমেন ইতিমধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'ভুলি নাই' বা 'বিয়াল্লিশ'-এর মতো ছবি করে দারুণ বিখ্যাত। তাই তাঁকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়ের ওপর লেখা বঙ্কিমের 'আনন্দমঠ'-উপন্যাসটির চিত্ররূপ নির্মাণের জন্য ফিল্মিস্থান দায়িত্ব দিতে চায়। তিনখানা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করে হেমেন ও হেমন্তর মধ্যে একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে। ফলে, বম্বের ডাক পেতেই তিনি হেমন্তকেও ডাক দিলেন। হেমন্ত তখন অজয় কর-এর 'জিঘাংসা'-ছবির কাজ করছেন। প্রথম অভিজ্ঞতা ফলপ্রসূ হয়নি, তার ওপর বাংলায় কাজের কোন অভাব নেই--ফলে, দুম করে হেমন্তের বম্বে যেতে মন চাইল না। কিন্তু, হেমেনের পীড়াপীড়িতে এবং স্ত্রী বেলার উৎসাহে হেমন্ত বম্বে পাড়ি দিলেন। আশ্রয় নিলেন হেমেনের বম্বের বাড়িতেই।
ফিল্মিস্থান স্টুডিওর মালিক নন, কিন্তু সর্বেসর্বা শশধর মুখার্জি। তিনি নিজে সঙ্গীতের তেমন কিছু জানেন না, কিন্তু তাঁর কান যেন একেবারে দর্শক-শ্রোতার কান। তিনি দর্শকদের রুচি জানেন, ফলে, কানের বিচারে তিনি যে-গান পছন্দ করেন, তাই-ই দর্শকরা নেয়! তাই কোন ছবিতে কোন কোন গান ব্যবহৃত হবে--সে ব্যাপারে তিনিই শেষ কথা বলেন। ফলে, মানুষটি একটু কাঠখোট্টা হলেও, হেমেন যখন হেমন্তকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, তিনি হিরে চিনতে ভুল করলেন না। হেমন্তকে মাস-মাইনের সঙ্গীত-পরিচালক ও গায়ক হিসেবে নিয়ে নিলেন। মাসে পনেরোশো টাকা মাইনে দেওয়া হবে। হেমন্তকে এগারোটা-পাঁচটা স্টুডিওতে হাজিরা দিতে হবে। এক একটা গানের জন্য বিশ-পঁচিশটা সুর করতে হবে। আর তা-থেকে শশধর বেছে নেবেন পছন্দের সুরটি। ফিল্মিস্থানের বাইরে হেমন্ত সুর দিতে পারবেন না, কিন্তু গান গাইতে পারবেন। ব্যস, হয়ে গেল ভদ্রলোকের চুক্তি।
'আনন্দমঠ' - এর সুর করতে গিয়ে হেমন্ত 'বন্দেমাতরম' গানটিতে মারচিং সং-এর সুর বসালেন। ঠিক করলেন, লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়াবেন। কিন্তু মুশকিল হল, লতার সঙ্গে তখন ফিল্মিস্থানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ! কিছুদিন আগেই দারুণ ঝামেলা হয়েছে। লতা সেই থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন - জীবনে আর ফিল্মিস্থানের সঙ্গে কাজ করবেন না! এসব শুনেও হেমন্ত কিন্তু কিছুতেই ভাবতে পারছেন না যে, গানটি অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াবেন! কেবলই মনে হচ্ছে যে, যেভাবেই হোক লতাকে রাজি করাতেই হবে! কাজেই, শশধরের অনুমতি নিয়ে সটান পৌঁছে গেলেন একেবারে লতার বাড়ি। প্রথম আলাপের আন্তরিকতাতেই বাংলা শার্ট আর ধুতি পরা এই নিপাট মানুষটি লতার 'হেমন্ত্দাদা' হয়ে গেলেন। যে লতার বাড়িতে মিউজিক ডিরেক্টাররা এসে গান তুলিয়ে যান, যে লতা দু'একটি টেকেই গান ফাইনাল করে ফেলেন, যে লতা কোন টেকটি থাকবে সেটাও ঠিক করেন, যে লতা তাঁর একটি গানের জন্য যা সাম্মানিক দাবি করেন প্রযোজক তাই-ই দিতে বাধ্য হন; সেই লতা হেমন্তর বাড়িতে চারদিন গেলেন গান তুলতে, কুড়ি-একুশটি টেক দিলেন হেমন্তর মুখ চেয়ে পরিচালককে খুশি করতে, কোন টেকটি ফাইনাল হবে সে-ব্যাপারে কোন কথা বললেন না, এমনকি সাম্মানিকের কথা তোলায় স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, 'যা করেছি দাদা, সব আপনার জন্য'! আহা, সম্পর্ক এমনও মধুর হয়! এই সুসম্পর্ক সারাজীবন অটুট ছিল। তাই তাঁদের যুগলবন্দিতে অসাধারণ সব গান পেয়েছি। মানুষ হিসেবে হেমন্তর আন্তরিকতা নিখাদ ছিল বলে, নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন বলেই বোধ হয় হেমন্ত লতা ছাড়াও বম্বের আর-সব্বার প্রিয় 'হেমন্ত্দাদা' হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে, তাঁর এক ডাকে লতা ও গীতা দত্তের মতো সুবিখ্যাত স্বনামধন্য দুই গায়িকা 'মরুতীর্থ হিংলাজ' ছবির 'পথের ক্লান্তি ভুলে'-গানটিতে শুধুমাত্র কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছেন, ভাবা যায়!
ফিল্মিস্থানের কপাল খারাপ, কিছুটা হেমন্তরও--পর পর তিনটি ছবি 'আনন্দমঠ', 'শর্ত' ও 'সম্রাট' ফ্লপ করল। হেমন্ত অসাধারণ সুর করলেন প্রত্যেকটি ছবিতে - কিন্তু, ছবি না চললে, দর্শকের কাছে না পৌঁছতে পারলে তো আর গানের কদর হয় না। সবার বাড়িতে তো আর গ্রামোফোন নেই। হেমন্ত ভাবলেন, এবার বুঝি এখানকার বাস উঠল! হিট দিতে না পারলে মাইনে দিয়ে স্টুডিও তাঁদের রাখবেই বা কেন! অনেক হয়েছে, কেউ কিছু বলার আগে সম্মান বাঁচিয়ে মানে মানে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরাই ভালো! কিন্তু, শশধর তাঁকে খুব ভালোবাসতেন, অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি সব শুনে সেই স্নেহের সুরেই বললেন যে, একখানা হিট না-দিয়ে কিছুতেই যাওয়া যাবে না। তিনি যখন হেমন্তকে চাকরিতে নিয়েছেন, তখন এটা তাঁরও প্রেস্টিজের ব্যাপার! এর ওপর আর কথা চলে না। সুতরাং, এ-যাত্রায় হেমন্তের বম্বে ছাড়া হল না।
বম্বে না - হয় ছাড়লেন না। কিন্তু, এদিকে দিনও যে ভালো করে চলে না। কারণ, ততদিনে স্ত্রী-পরিবারকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে বম্বের বাসিন্দা হয়েছেন হেমন্ত। ফলে, দেড় হাজার টাকায় সংসার চালানো বড় মুশকিল হয়েছে। গান গেয়ে ফিল্মিস্থান থেকে তো টাকা পাওয়া যায় না। তাই হেমন্ত বাইরে গেয়ে উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা করতে শুরু করলেন। গান গাইবার আর্জি নিয়ে গেলেন শঙ্কর-জয়কিষনের কাছে। হিন্দি ছবির সুরকার হিসেবে তাঁদের খুব নাম। তবুও হেমন্তর অসহায়তা বুঝে তাঁরা স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন যে, সঙ্গীত পরিচালক হয়ে হেমন্ত তাঁদের টক্কর দেবেন, আর গানও গাইবেন - এটা তাঁরা পছন্দ করছেন না! হেমন্ত যদি সঙ্গীত পরিচালনা ছাড়েন, তাহলে তাঁরা সুযোগ দিতে রাজি। কিন্তু, গান গাওয়া আর সুর দেওয়া যে হেমন্তের একই স্বপ্নের দুটি ডানা! যে স্বপ্নের জন্য তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়েছেন, সেই স্বপ্নের ডানা ছাঁটবার কথা বলেছেন এঁরা! এ কি মেনে নেওয়া যায়? না, মানতে পারলেন না। সেখান থেকে বেরিয়ে অনেক তাবড় সঙ্গীত-পরিচালকের দরজাতেই কড়া নাড়লেন। কিন্তু, কোথাও সাদর অভ্যর্থনা পেলেন না। শেষে গেলেন শচীন দেব বর্মণের কাছে। হ্যাঁ, এই মানুষটি, একমাত্র এই মানুষটিই এগিয়ে দিলেন তাঁর স্নেহসিক্ত হাত। 'সাজা' ছবিতে হেমন্তকে দিয়ে গাওয়ালেন, কিন্তু ছবিটা চলল না। পরের ছবি, 'জাল'। এতে হেমন্ত গাইলেন, 'ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনি ফির কাঁহা'-গানটি। ছবি হিট হল, গানও সুপারহিট। লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল গানের কলি, আর গায়কের নাম, 'হেমন্ত্ কুমার'! ব্যস, গায়ক হেমন্তকে আর বম্বের মাটিতে ফিরে তাকাতে হল না।
এলো ১৯৫৪ সাল। ফিল্মিস্থান এবার দুটি ছবি করবে বলে ঠিক করল। একটি 'আনারকলি', অন্যটি 'নাগিন'। হেমন্তর কপালে জুটল 'নাগিন' ছবির মিউজিক করার ভার। 'নাগিন' যেহেতু সাপুড়েদের গল্প। হেমন্ত তাই মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে বীণকে প্রাধান্য দিলেন পুরো ছবিতে। মিউজিকে বীণ-এর প্রাধান্য দেখে পরিচালক নন্দলালজী বা শশধর মুখার্জি - দুজনেরই পছন্দ হল না। নিছক 'প্যাঁ প্যাঁ' একঘেঁয়ে বলে মনে হল। কিন্তু, এই প্রথম হেমন্ত শশধরের কথা শুনলেন না, বললেন যে, বীণের এই একঘেঁয়ে সুরই থাক, এতেই দর্শক-শ্রোতা সুরের মোহে মাতাল হবে! কল্যাণজীকে দিয়ে ক্ল্যাভিওলাইন যন্ত্র বাজিয়ে সাপের বাঁশির এফেক্ট আনলেন। গান গাইলেন নিজে। হেমন্তের ভবিষ্যৎবাণী সার্থক করে ছবিটি অসম্ভব রকমের সফল হল। সেই সফলতা সম্পর্কে হেমন্ত নিজে লিখছেন: "উনিশশো চুয়ান্ন সালের কথা আমি ভুলব না কোনদিন। এই সালটা আমাকে দিয়েছে অনেক। বম্বে ছেড়ে চলে আসব বলে যখন আমি মনে মনে প্রস্তুত, তখন এই উনিশশো চুয়ান্ন আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। এই সালে 'নাগিন' রিলিজ হল। ছবি সুপারহিট। আর গান! গান বাদ দিলে এ-ছবি তো একেবারে ন্যাড়া বেলগাছ। সকলের কান ধরে ফেলেছে গানগুলো। আর সেই বীণের সুর, যাকে নন্দলালজী প্যাঁ প্যাঁ বলেছিলেন, সেটা হয়ে গেছে পি.সি.সরকারের 'ওয়াটার অব ইন্ডিয়া'। এ-ছবির গানের রেকর্ড এত বিক্রি হয়েছিল, যা গত বিশ বছরে আর কোন ছবির বরাতে জোটে নি...।" আর এই ছবির সফলতার সঙ্গে সঙ্গেই বম্বের মাটিতে সব্বার প্রিয় 'হেমন্ত্দাদা', বরেণ্য সঙ্গীত-পরিচালক হেমন্ত্ কুমারের যে জয়যাত্রা শুরু হল, তা গঙ্গার ধারার মতো পবিত্র ও স্নিগ্ধ স্রোতে বইতে শুরু করল, দিল অপার-মুক্ত সুরসাগরের সন্ধান...
তথ্যঋণ: 'আনন্দধারা' - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়; 'দেশ'- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সংখ্যা - ১১ নভেম্বর ১৯৮৯।