‘নীলবাঁদরে সোনার বাংলা
করলে এবার ছারখার।
অসময়ে হরিশ ম’ল;
লঙের হল কারাগার
প্রজার প্রাণ বাঁচানো ভার।’
হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর নীলচাষিদের দুর্দশা স্মরণ করে বড় দুঃখে জনৈক লোককবি এই গান বেঁধেছিলেন। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে, নীলচাষিদের সহায় হয়ে অত্যধিক পরিশ্রমে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে ‘অসময়ে’ অত্যন্ত অল্প (মাত্র সাঁইত্রিশ বছর) বয়সে হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হয়। জীবন দিয়েও পরোপকারের ব্রতকে কেমন করে অগ্রাধিকার দিতে হয়, তা যেমন তিনি শিখিয়েছিলেন; তেমনি শিখিয়েছিলেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিষ্ঠা এবং প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কীভাবে দারিদ্র্য অতিক্রম করে সমাজের পাঁচজনের একজন হওয়া যায়।
হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে মামারবাড়িতে। ভবানীপুরে। ক্রমে মামারবাড়িই হয়ে উঠেছিল তাঁর বাড়ি। কেননা, তাঁর পিতা রামধন ছিলেন বর্ধমানের শ্রীধরপুরের কুলীন। হরিশ্চন্দ্রের মা রুক্মিণী দেবী ছিলেন তাঁর তৃতীয় পক্ষ। রুক্মিণী কখনও বর্ধমানের মুখ দেখেননি। তার ওপর হরিশ্চন্দ্রের ছ’মাস বয়স হতে-না-হতেই রামধনের মৃত্যু হয়।
মামারবাড়ির অবস্থা খারাপ ছিল না, কিন্তু রুক্মিণী ভাইদের কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য পাননি। মাথার ওপর ছাদটুকু যে তাঁরা কেড়ে নেননি, এটুকুই অবশ্য তাঁর কাছে ছিল অনেক। রুক্মিণীর দুই পুত্রসন্তান, হারাণচন্দ্র ও হরিশ্চন্দ্র। কাজেই তিনটে পেট চালাতে তাঁকে সুতো কেটে, টুকিটাকি হাতের কাজ করে উপার্জন করতে হত। তাতেও অবশ্য অভাব মিটত না। অপরিসীম দারিদ্র্যে উপোষ দিয়ে, আধপেটা খেয়ে চলছিল একলা মায়ের লড়াই। বেতন দিয়ে ছেলেদের ভালো স্কুলে পড়ানোর সাধ্য তাঁর ছিল না। তাই ছেলেরা পাড়ার পাঠশালায় কিছুদিন পড়ে ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে আবেদন করে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান।
হরিশ্চন্দ্র মাতৃভাষা পাঠশালায় শিখে দাদার কাছেই ইংরেজির পাঠ নিতে শুরু করেছিলেন। ভবানীপুর ইউনিয়নে ভর্তি হয়ে মেধা দিয়ে শিক্ষকদের তিনি একেবারে তাক লাগিয়ে দিতেন। এমন কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতেন যে, শিক্ষকেরা উত্তর দিতে হয়রান হয়ে যেতেন। অবশ্য এর জন্য তাঁরা তাঁকে ভালোও বাসতেন। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে মানুষ হওয়ায় হরিশ্চন্দ্র ছোট থেকেই যেমন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে শিখেছিলেন, তেমনি বেশ ডাকাবুকো স্বভাবেরও হয়ে উঠেছিলেন। একবার এক ইংরেজ মাতাল স্কুলের সামনে বেয়াদপি করছিল। সে-সময়ে ইংরেজ অন্যায় করুক আর যা-ই করুক, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস সাধারণ দেশীয়দের ছিল না, মুখ বুজে সহ্য করাই ছিল রীতি। সেখানে হরিশ্চন্দ্র কিন্তু স্কুলের ছেলেদের নিয়ে জোট বেঁধে তাকে স্কুলের ত্রিসীমানা থেকে একেবারে বিতাড়িত করে ছেড়েছিলেন।
দারিদ্র্যের কারণেই ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলেই হরিশ্চন্দ্রের লেখাপড়া শেষ হয়ে যায়। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই তাঁকে চাকরির চেষ্টা করতে হয়, কেননা জ্যেষ্ঠভ্রাতা তখনও পর্যন্ত কাজকর্ম কিছুই জুটিয়ে উঠতে পারেননি। হরিশ্চন্দ্রের বয়স কম, বিদ্যেও কম—তাতে চাকরি দেবে কে! অফিসে অফিসে ঘুরে কিছুতেই সুবিধে হয় না। তবুও তিনি হাল ছাড়লেন না। অনেক যাতায়াত অনেককে ধরাধরি করে অবশেষে দশ টাকা মাইনের বিল লেখকের চাকরি পেলেন ‘টলা কোম্পানি’ নামের এক নীলাম অফিসে। কথা ছিল কিছুদিন কাজ করার পর মাইনে বাড়বে। কিন্তু তা না পাওয়ায়, হরিশ্চন্দ্র যখন মাইনে বৃদ্ধির কথা বললেন, তখন অপমানিত হলেন। দারিদ্র্যের মধ্যেও আত্মমর্যাদা রক্ষার শিক্ষা তাঁর ছিল, তাই হরিশ্চন্দ্র কাজই ছেড়ে দিলেন। এরপর বাড়িতে এমন অবস্থা হল যে, ঘটিবাটি বন্ধক রেখে আহারের ব্যবস্থা করা ছাড়া উপায় রইল না। তবুও কাজ ছাড়তে তিনি দু’বার ভাবেননি।
কিছুদিন পর মুরুব্বি ধরে মিলিটারি অডিটর জেনারেল অফিসে পঁচিশ টাকার চাকরি পেলেন। এই চাকরিটি পাওয়ার পরই তাঁর সংসারে উন্নতি শুরু হল। সংসারের অভাব তাতে তো মিটলই, সেই সঙ্গে পড়াশুনোর যে ঐকান্তিক ইচ্ছা তাঁর মনের মধ্যে ছিল, তাও চালিয়ে যাবার সুযোগ পেলেন। বই কিনে এবং লাইব্রেরির সভ্য হয়ে ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্র থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি বিবিধবিষয়ক বই নিরবধি পাঠ করে প্রগাঢ় পণ্ডিত হয়ে উঠলেন কয়েক বছরে। নিজের চেষ্টায় ইংরেজি ভাষায় এমন বুৎপত্তি অর্জন করলেন যে, লোকে তাঁর কাছে আদালতের কাগজপত্র অনুবাদ করাতে আসতে শুরু করল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘হিন্দু ইন্টেলিজেন্সার’ নামের এক প্রখ্যাত ইংরেজি কাগজে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করল। তা থেকেই উনিশ শতকের কলকাতার একজন বিশিষ্ট ইংরেজিবেত্তা ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে শিক্ষিতমহলে হরিশ্চন্দ্রের নাম ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে চাকরিস্থলেও ক্রমে তাঁর বেতন বাড়তে বাড়তে চারশো টাকায় এসে ঠেকল।
শিক্ষিতমহলে প্রভাব বাড়তেই হরিশ্চন্দ্র বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ব্রাহ্মসমাজের একজন গণ্যমান্য লোক হয়ে উঠলেন। ভবানীপুরে সমাজের একটি শাখা স্থাপন করে ব্রাহ্মসমাজের প্রচারে সর্বপ্রথম ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়ার রীতি প্রবর্তন করলেন। এই সময় মধুসূদন রায় নামের এক ধনী ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামের ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করে তাঁকে লেখক-সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিন্তু পত্রিকা চালানো মধুসূদনের কর্ম ছিল না, তাই কয়েক বছর পত্রিকা চালিয়ে শেষমেশ তিনি তা হরিশ্চন্দ্রকে বিক্রি করে দিলেন।
‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর স্বত্ত্ব পেয়ে এবার দেশহিতৈষণার এক নতুন অধ্যায় শুরু হল হরিশ্চন্দ্রের জীবনে। এই সময় বাংলার বুকে নীলচাষকে কেন্দ্র করে নীলকরদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে কৃষকের অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছিল। ইংরেজের পত্রিকা বিষয়টিকে এড়িয়ে গেলেও হরিশ্চন্দ্র তাঁর ক্ষুরধার কলম নিয়ে ও পরামর্শদাতা হিসেবে দাঁড়ালেন নীলচাষিদের পাশে। নীলবিদ্রোহের মশালটি নিরবধি জ্বালিয়ে রাখতে ইন্ধন জোগাতে লাগলেন। সেই সময়টিকে ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী অত্যন্ত দরদের সঙ্গে তুলে ধরেছেনঃ
‘মানুষের দেহে আর কত সয়!...রাত্রির কয়েক ঘন্টা ব্যতীত হরিশের আর বিশ্রাম ছিল না। একে ‘‘পেট্রিয়ট’’ পত্রিকার সম্পাদকতা কাজ, সেজন্য তাঁহাকে রাশি রাশি সংবাদপত্র পড়িতে হইত, ও প্রবন্ধাদি লিখিতে হইত, তদুপরি দিবারাত্রি নীলকরপ্রপীড়িত প্রজাবৃন্দের সমাগম। তাঁহার ভবন সর্বদা লোকারণ্য থাকিত। কাহারও দরখাস্ত লিখিয়া দিতে হইতেছে, কাহাকেও উকিলের নিকট সুপারিস চিঠী দিতে হইতেছে, কাহারও মোকদ্দমার হাল শুনিতে হইতেছে; বিশ্রাম নাই। অনেক দিন আফিস হইতে ফিরিয়া রাত্রি দ্বি প্রহর পর্যন্ত আর আফিসের পোশাক বদলাইবার সময় পাইতেন না। আফিসের কলম ছাড়িয়া আসিয়া আবার কলম ধরিয়া বসিয়া যাইতেন। তাঁহার জননী এই গুরুতর শ্রমের প্রতিবাদ করিয়া টিক টিক করিতেন। বলিতেন, “ওরে মানুষের এত শ্রম সবে না, ওরে মারা পড়বি, ওরে কলম রাখ।” তদুত্তরে তিনি বলিতেন—“মা, তোমার সব কথা শুনবো, কিন্তু এই গরীব প্রজাদের জন্যে যা করছি তাতে বাধা দিও না, ওরা ধনে প্রাণে সারা হলো, এ কাজ না করে আমি ঘুমাতে পারবো না।”
এই ছিলেন হরিশ্চন্দ্র। মায়ের আশঙ্কা সত্যি করে তিনি অমানুষিক পরিশ্রম সহ্য করতে না-পেরে অকালে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পরও কিন্তু নীলচাষিদের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধ থেকে হরিশ্চন্দ্র মুক্তি পাননি। নীলকরের ক্রোধ তাঁর বিধবাপত্নীকেও আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁকে নিঃস্ব করে হাজার টাকা জরিমানা দিতে বাধ্য করিয়েছিল। নীলকরদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো লঙ সাহেবের সাথে তবুও কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন, হরিশ্চন্দ্রের বিধবার পাশে সেদিন কেউ ছিল না…