বিলিতি অফিসের বাঙালি বস। অকারণে চাকরি থেকে জবাব দিয়েছেন এক মহিলা কর্মীকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেই মহিলার চাকরি কাড়ার প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন আর এক মহিলা কর্মী। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির বধূটি ‘বস’কে ‘জবাব’ চাইছেন। ভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। তিনিই ছবির নায়িকা। কিন্তু সেই সিনে দর্শকদের প্রায় সবটুকু নজর শুষে নিয়েছিলেন কড়া মেজাজের সেই বসটি।
ভূমিকায় হারাধন বন্দোপাধ্যায়। অফিসের জাঁদরেল বস হোক বা সুযোগসন্ধানী বড় কত্তা সবেতেই তিনি ‘পারফেক্ট’!
আদি বাড়ি বাংলাদেশ। দেশভাগের পর চলে আসেন এপার বাংলায়। স্কুলের পড়াশোনা সেখানেই। কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন সিটি কলেজে।
‘কেরিয়ার’ শুরু হয়েছিল গান অ্যান্ড সেল ফ্যাক্টরি। তবে সে চাকরি বদলেও নেন। অভিনয়ের নেশা যে টানছে। যোগ দেন ওরিয়েন্টাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে। সেখান থেকেই অবসর।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। জেলেও যেতে হয়েছিল তার জন্য। ৬৫ বছরের অভিনয় জীবন। অভিনয় করেছেন একশোর বেশি ছবিতে। অতনু বন্দোপাধ্যায়ের ছবি "দেবদূত" দিয়ে শুরু হয় অভিনয় জীবন।
কিন্তু সে আসা হঠাৎ করে নয়। প্রদীপ জ্বালার আগে সলতে পাকানোর পর্ব অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মঞ্চ আর বেতারে।
দু জায়গাতেই অভিনয় করতেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, কড়া উচ্চারণ আলাদা করে চিনিয়ে দিত তাঁকে। সাহেবী কেতার ইংরেজি অ্যাকসেন্ট তাঁর ট্রেডমার্ক।
‘অভিনয়’ করতে হত না, হারাধন বন্দোপাধ্যায়ের কাছে অভিনয় ছিল সহজাত। ক্যামেরা চালু হলেই তিনি ‘অন’। কোথাও এতটুকু বাড়তি কারিকুরি নেই। চরিত্র আর অভিনেতা একেবারে এক।
তাঁর কোনও মেন্টর ছিল না। উৎপল দত্তের "ফেরারী ফৌজ" নাটকে নজর কেড়েছিলেন। অহীন্দ্র চৌধুরি, ছবি বিশ্বাস, উৎপল দত্ত প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তিনি এক সঙ্গে কাজ করেছেন।
"কাপুরুষ-মহাপুরুষ", "সোনার কেল্লা", "শাখা-প্রশাখা", "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি", "চৌরঙ্গী", "ওগো বধূ সুন্দরী", "আকাশ কুসুম", "কড়ি দিয়ে কিনলাম", "দাদার কীর্তি" অজস্র ছবি তাঁর ক্রমসরনীতে। কিন্তু ‘রিপিট’ চরিত্রে কখনও দেখা যায়নি তাঁকে।প্রতিবারই নতুন।
২০০৫ সালে ক্রান্তিকাল ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার।
পার্শ্বচরিত্ররাও কীভাবে ছাপিয়ে যেতে পারে, কীভাবে নজর কেড়ে নিতে পারে দর্শকদের তার আদর্শ উদাহরণ ছিলেন হারাধন।
ছবি বিশ্বাস, বিকাশ রায়, তুলসি চক্রবর্তী, পাহাড়ী সান্যালদের মতো অভিনেতাদের উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন। শেষ সার্থক উত্তরাধিকার বোধহয় তাঁকেই বলা যায়।
তিন প্রজন্ম ধরে পর্দায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। অভিনয় করেছেন প্রায় সব বয়সী অভিনেতাদের সঙ্গে। অভিনয়ের সবকটি মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর জীবন সময়ের দলিল।