ব্রতচারী আন্দোলনের জনক গুরুসদয় দত্তের শখ-কথা

গুরুসদয় দত্ত গুণী মানুষ। গুণী মানুষের অনেকগুলো দিক থাকে। তাঁরও ছিল। তিনি ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদে চাকরি করেও সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার, তাদের বিপদে-আপদে ছুটে যাওয়ার ব্রতে যেমন অক্লান্ত ছিলেন; তেমনি নিমগ্ন হয়েছিলেন বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতিকে চর্চা এবং চর্যার মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার ব্রতেও। 

নিজে যেমন ওই ব্রতে আমৃত্যু ব্রতচারী ছিলেন, তেমনি বাংলার যুবক-যুবতীদের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদেরও ব্রতচারী করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই যে লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিকে বাঁচানো, সুপ্তপ্রায় সৌভ্রাতৃত্বকে জাগানো এবং তার মধ্য দিয়ে বাঙালির ঐক্যবোধ ও স্বদেশচেতনাকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা--এর তুলনা কোথায়? 

তাই গুরুসদয়কে নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই 'বেস' হয়ে ওঠে 'ব্রতচারী'। কিন্তু, আমরা তাঁর এই সত্তাটি নিয়ে আলোচনা করব না। তুলে ধরব তাঁর অন্য অনালোচিত একটি দিক:

উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে বন্যপ্রাণী শিকার বৈধ ছিল। কিছু ক্ষেত্রে শখের, কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের ব্যাপার ছিল। রাজা, জমিদার, অভিজাতদের কাছে শখের; বন্যপ্রাণী উৎপীড়িত অঞ্চলে প্রয়োজনের। জিম করবেটের শিকার-কাহিনি,  যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'বনে-জঙ্গলে', প্রমদারঞ্জন রায়ের 'বনের খবর' প্রভৃতিতে তার পরিচয় আছে। গুরুসদয় শিকারের ব্যাপারে দারুন শৌখিন ছিলেন। তার সঙ্গে কখনো-সখনো প্রয়োজনও মিলেছে।

বলতে কী, শিকার-শৌখিনতা এতটাই গভীর ছিল যে, তার জন্য একদা বাংলার মাটি ছেড়ে অন্য প্রদেশে পড়ে থাকতেও তাঁর সামান্য দ্বিধা ছিল না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন চলছিল, সেই সময় কর্মসূত্রে তিনি বিহার অঞ্চলেই ছিলেন। কিন্তু, আন্দোলন রদ হওয়ার পর বিহার যখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছেড়ে আলাদা প্রদেশ হয়ে গেল; তখন অনেকেই বাংলায় বদলি হয়ে চলে এলেও, তিনি সেখানেই থেকে যেতে চাইলেন। তার একটাই কারণ, শিকার।

GurusadayDutt1

বন-জঙ্গল অধ্যুষিত বিহারে বন্যপ্রাণীর অভাব ছিল না। তাছাড়া জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে নতুন নতুন রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হওয়ার ফলে দেদার বন কাটা চলছিল এবং বন্যপ্রাণীদের লোকালয়ে হানা দেওয়ার পরিমাণও বাড়ছিল। তাই বিহারের প্রতিটি জেলায় জেলায় শৌখিন ও প্রয়োজনীয় শিকারের প্রাচুর্যও দেখা যাচ্ছিল তখন। আর এই টানেই সেখানে থাকা মনস্থির করে ফেললেন গুরুসদয়। 

কিন্তু, সিদ্ধান্তে বাদ সাধলেন স্ত্রী সরোজনলিনী। বললেন, "দেখ, সমস্ত জীবন ত আর শীকার লইয়া থাকিবে না। নিজের প্রদেশের লোকের সঙ্গে তোমার বেশী জানাশুনা আছে, বাংলাভাষা তোমার মাতৃভাষা, সুতরাং বাংলাদেশেই কাজ করা উচিত। তাহা হইলে দেশের অনেক কাজ করিতে পারিবে।"

স্ত্রীর কথা গুরুসদয় শুনেছিলেন। কারণ, সরোজনলিনী স্বভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণ তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে বাঙালিয়ানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যথেষ্ট ডাকাবুকোও ছিলেন। শাড়ি পরেও অসাধারণ টেনিস খেলতেন, অসম্ভব ভালো ঘোড়ায় চড়তেন, অসীম-সাহসে স্বামীর শিকার-সঙ্গীও হতেন।

নেপাল ও পূর্ণিয়ার জঙ্গলে হাতির পিঠে চড়ে বেশ রাজকীয় ঢঙে যেমন বেশ কয়েকবার গুরুসদয়-সরোজনলিনী শিকার করেছেন, তেমনি বৃহৎবাংলার সুন্দরবনেও বহুবার শিকার করেছেন কেবল পায়ে হেঁটে। ফলে, একইসঙ্গে শিকারের দুর্দান্ত এডভেঞ্চার ও অনন্য অভিজ্ঞতা ক্রমাগত জমা হয়েছিল তাঁর ঝুলিতে।

সে-বার কর্মসূত্রেই সুন্দরবন পরিদর্শনে বেরিয়েছেন গুরুসদয়। বাহন, ছোট্ট জাহাজ। সঙ্গী সরোজনলিনী, জঙ্গল বিভাগের সহকারী কনসারভেটর মিঃ কাকপেট্রিক এবং কয়েকজন খালাসি। জাহাজে যেতো যেতে গুরুসদয়ের মন জাগল এই সুযোগে রথ দেখা ও কলা বেচার ইচ্ছে। তবে কাউকে সেটা জানতে দিলেন না।

যথা সময়ে জাহাজ নোঙর করল বনের দক্ষিণ সীমান্তে। তখন গুরুসদয় তাঁর মনোবাঞ্ছার কথা জনান্তিকে জানাতেই কাকপেট্রিক সবিনয়ে জানালেন যে, এখানে তো অন্য ব্যবস্থা নেই, তাই শিকার করতে হলে হেঁটেই জঙ্গলে ঢুকতে হবে; আপনি তো জানেনই সেটা বেশ বিপজ্জনক... 

গুরুসদয় জানালেন যে, কুছ পরোয়া নেই। সুযোগ যখন আছে, তখন শিকারে যাবেনই। তারপর যা থাকে কপালে! শুধু সরোজনলিনীকে ব্যাপারটা বলা যাবে না। জানতে পারলে সঙ্গে যাবেই। তখন বিপদে পড়লে আফসোসের শেষ থাকবে না।

বেশ। কাকপ্যাট্রিক নিজেও খুব এডভেঞ্চারপ্রিয় লোক। সেও এই 'চুপিচুপি' ব্যাপারটায় বেশ মজা পেল।

পরামর্শ অনুযায়ী কাজের নাম করে গুরুসদয়রা বেরোলেন বটে, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না।  সঙ্গে সঙ্গে না-হলেও, খানিক পরে সরোজনলিনী ঠিক ধরে ফেললেন যে, তাঁর স্বামীটি কাজ নয়, শখ মেটাতে বেরিয়েছেন! 

ফলে, কয়েকজন খালাসিকে নিয়ে জাহাজ ছেড়ে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে সোজা জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। তারপর গুরুসদয়দের খুঁজতে খুঁজতে ঠিক ধরে ফেললেন। সেই মুহূর্তে গুরুসদয়ের অপ্রস্তুত অবস্থাটা ছিল দেখার মতো!

GurusadayDutt2

এ-দিন অবশ্য শিকার কিছু পাওয়া গিয়েছিল কি না জানা যায় না, তবে বিপদ-আপদ যে কিছু ঘটেনি তা বলাই বাহুল্য।

আর-একদিনের কথা। জাহাজ সে-দিন খুলনা-সুন্দরবনের একটি জায়গায় নোঙর করল। শিকারের আশায় গুরুসদয় সমভিব্যাহারে বনের ভেতর ঢুকলেন। না, এবার আর সরোজনলিনীকে ফাঁকি দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন না। তাঁকেও সঙ্গে নিলেন।

দু'একটা হরিণ শিকার করতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু, তাতেও তাঁরা থামলেন না। চাইলেন বাঘ-রাজার সন্ধান পেতে। সুতরাং, সদলে বন্দুক হাতে নিয়ে ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ফেউয়ের ডাকের অপেক্ষায় কান খাড়া করে তাঁরা খুব চুপি চুপি এগোতে লাগলেন। এমন সময় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। তাই, ফেরার সিদ্ধান্ত নিতেই হল।

ফেরার পথে শুনলেন ফেউয়ের ডাক। অভিজ্ঞতার অনুভবে বুঝলেন যে, তাঁরা এতক্ষণ যাকে খুঁজছিলেন, সে-ই এখন তাঁদের খোঁজ পেয়েছে। বাঘ তাঁদের পিছনে লেগেছে। অনুসরণ করছে। 

সরোজনলিনীর অভিজ্ঞতাও কম নয়। তাই বিপদ তিনিও টের পেলেন সঙ্গীদের ইশারার আগেই। অমনি স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। গুরুসদয় সেই কঠিন স্পর্শে পেলেন অফুরন্ত ভরসা...

না, এবারও কোন বিপদ হয়নি। বাঘকে ভয় দেখিয়ে বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে সকলেই প্রবল সাহস ও উৎকণ্ঠা নিয়ে শেষ পর্যন্ত বন থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

গুরুসদয় ছড়ার বই লিখেছেন, গানের বই লিখেছেন, লোকসংস্কৃতি নিয়ে বই লিখেছেন; কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, শুধুমাত্র শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটিও বই লেখেননি। লিখলে, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ও সহজ ভাষা-সৌন্দর্যের মিলনে তা যে অত্যন্ত সুখপাঠ্য সম্পদ হয়ে বাংলা শিকারকাহিনির ধারাটিকে পুষ্ট করত, তা বলাই বাহুল্য।


ঋণ :  'সরোজনলিনী' (১৯২৫)--গুরুসদয় দত্ত। স্ত্রী সম্পর্কিত এই স্মৃতিগ্রন্থে শুধুমাত্র ছুঁয়ে যাওয়া শিকার-প্রসঙ্গ আমার অবলম্বন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...