কলকাতার লিভার ব্রাদার ফ্যাক্টরিতে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি। অফিসে যত টেলিফোন আসবে তার ‘কানেকশন’ দেওয়াই সারাদিনের কাজ। বছর বিশের তরুণটির সে কাজে মন নেই। ভালোলাগে না তার টেলিফোন অপারেটরের চাকরি। মনে-মনে টানাপড়েন চলে। কানের মধ্যে বাজতে থাকে গানের সুর সযেন অন্য কোনও টান। অদ্ভুত অস্থিরতায় স্বাদহীন তার জীবন। নিরন্তর উত্তর খুঁজে চলে দক্ষিণী তরুণটি। অথচ উত্তর মেলে না।
সারাজীবন ধরে সে কেবল উত্তর খুঁজে ফিরেছে। শুধু বদলে গিয়েছে প্রশ্নগুলো। সফেন সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে জীবন তাকে পৌঁছে দিয়েছে মায়ানগরীর কিনারায়। রূপালী পর্দার মায়াবী এক বিষাদ পুরুষ। দুনিয়া চিনল ‘গুরু দত্ত’নামে।
আসল নাম বসন্তকুমার শিবশঙ্কর পাডুকন। জন্ম বেঙ্গালুরুতে। সালটা ১৯২৫, ৯ জুলাই। ১৯৩৫ সালে এক দুর্ঘটনায় বদলে ফেলতে হয় নাম। নতুন নামকরণ হয় ‘গুরু দত্ত’।
একেবারে ছোটবেলায় বাবামা’র সঙ্গে চলে আসা কলকাতায়। তারপর থেকে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরই হয়ে উঠেছিল নিজের শহর। দক্ষিণী পরিবারটির অন্দর মহলে বাংলা চর্চার পরিবেশ তো ছিলই, বরং তার হালচাল বলে বলে গোল দিতে পারত আর পাঁচটা বাঙালি পরিবারকে। তাঁর মা বাংলা সাহিত্য অনুবাদ করেছিলেন কন্নড় ভাষায়। বাড়িতে বাংলায় কথা চলত অনর্গল।
ছোটবেলা খুব সহজ ছিল না বসন্ত কুমারের। বাবা হেডমাস্টার। পরে ব্যাঙ্কে চাকরি নেন। মা বাসন্তী অত্যন্ত মেধাবী মহিলা ছিলেন। বাড়িতে মেধা আর ইগোর লড়াই দেখাই বড় হয়ে ওঠা।
কিন্তু নিজস্ব ভালোবাসার সৌরভ ঘিরে রাখত জীবনের এবড়োখেবড়ো পথকে। নাচের টানে পাড়ি দিয়েছিলেন আলমোড়া। উদয়শঙ্করের একাদেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন।
টেলিফোন অপারেটরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ১৯৪৪-এ পাড়ি দেন বোম্বাই নগরীতে। বাবা-মা’র কাছে। সেখানেই যেন অপেক্ষা করেছিল তাঁর নিয়তি। বাকি জীবন মায়া নগরীর মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকবেন কলকাতার গুরু। রঙ্গিন দুনিয়ায় কখনও গরল কখনও অমৃত কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ।
আলমোরার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই পুনেতে প্রভাত স্টুডিয়োতে কোরিওগ্রাফারের ভূমিকায় যুক্ত হলেন। তিনবছরের চুক্তি। প্রথম ছবি হাম এক হ্যায়(১৯৪৬)।
ছবির দুনিয়ায় তাঁরই মতো ‘স্ট্রাগল’ করতে আসা এক নবাগতর সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল তাঁর। বন্ধুর নাম দেব আনন্দ।
পরবর্তী বছরগুলোতে সিনেমাই তাঁর ‘ফ্রেন্ড-ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’ হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল সেই ধারা।