" জীবনের সব অভিজ্ঞতা হালকা হয় না, তবু হালকা হাসিকেই প্রাধান্য দিয়েছি, চেষ্টা করে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে।"
'পুরনো কাসুন্দি'র প্রথম পাতায় এই কথাগুলোই ছিল মুখবন্ধ। লিখেছিলেন বাদল সরকার। ভারতীয় নাটকের অদ্বিতীয় ইন্দ্রজিৎ। বাঁধ ভাঙার প্রমিথিউস হিসেবে। মধ্যবিত্তের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তধারায় মুক্তি দিয়েছিলেন থিয়েটারকে।
জন্ম উত্তর কলকাতায়। বাড়ি স্কটিশ চার্চ হোস্টেলের গলিতে। প্রথম নাম সুধীন্দ্র। সুধী দের সভায় ইন্দ্র। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে সুধী মহলে উজ্জ্বল মুখ হবেন। জুলাই বর্ষায় জন্ম বলে কাকা নাম দিয়েছিলেন ' বাদল'। সেই নামই লেপ্টে গেল জীবনের গায়ে-গায়ে। সুধীন্দ্র থেকে গেল শুধু স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজে।
ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে পড়ার পরিবেশ। গোটা বাড়ি জুড়ে শুধু বই, বই এর বই। মা-মাসি-দিদি-দিদিমা সব্বাই বইয়ের পাতায় ডুবে। বাবা মহেন্দ্রলাল সরকার স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রিন্সিপাল পদে ছিলেন। প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ।
বাড়ির বই- এর নেশা তাঁর মধ্যেও ছড়িয়েছিল। কিন্তু ইংরেজি বই পড়তে পারতেন না। আর বালক বদলের ভালো লাগার মত বাংলা বই বাড়িতে একটাও তেমন নেই।
শেষ পর্যন্ত ভরসা বন্ধুরা। ' একদিনের মধ্যেই পড়ে ফিরতে দেব'- এই কড়ারে বই চেয়ে নিয়ে আসতেন তাদের থেকে। কিন্তু পড়বেন কখন?
স্কুলের পড়া, খেলার মাঠ এসবের বাইরে সময় কোথায়। সময় বের করে নিতেন খেতে বসে। রাতে খেতে বসতেন। হাতে বই। সবাই খেয়ে উঠে যেত, থালার সামনে তিনি বসেই। বইয়ের মধ্যে ডুব।
নাটকের নেশার ছোঁয়াচটাও তখন থেকেই লেগেছিল। ছাপার অক্ষরে লেখা কাহিনী, কথা, সংলাপ বেজায় ভালো লাগত। একলা একলা নাটক পড়া। বুঁদ হয়ে থাকতেন। নাটকের চরিত্র বদলালেও অভিনেতা বদলাত না। এক থেকে যেত মঞ্চও। তেতলার ঘরে শোয়ার খাট।
আর ছিল রেডিয়ো। গোটা ছাত্র জীবনে একবারও হলে গিয়ে নাটক দেখার সুযোগ হয়নি। তবে আফসোস নেই। রেডিয়োতে জমে উঠত আসর। মঞ্চের সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের গলা চিনে গিয়েছিলেন এভাবেই।
তাঁর বয়সী বাকি ছেলেরা তখন খেলার মাঠে তুখোড়। সাঁ- সাঁ করে সাইকেল ছোটায়। সাঁতরে পার হেদুয়া। তিনি সে সবে বেশ পিছিয়ে। শিখতে শিখতে সময় কাবার। তবু বাকিদের মতো হয় না। হীনমন্যতায় ভোগেন। সবাই তাঁর চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু নাটকের টান আস্তে আস্তে বীজ বুনতে শুরু করেছে কাঁচা মনের মাটিতে। সেখানে কোনও দৌড় নেই। সেই তাঁর একলা ঘরের আশ্রয়।
ক্লাস সেভেনের বইতে পড়েছিলেন দুধর্ষ ডাকাত পিন্ডআরির কথা। ব্রিটিশদের সঙ্গে টক্কর। লাল হয়ে যায় মাটি। পরতে পরতে রোমাঞ্চ। পিন্ডআরির যুদ্ধ নিয়েই একখানা নাটক লিখলেন। তারপর সে কলম চলতেই থাকল নিয়তির পথে।
প্রথম থিয়েটার পনেরো বছর বয়সে। বাড়ির একতলার বসার ঘরের মঞ্চে। শাড়ি-ধুতি- চাদরের ব্যাকড্রপ।
সেই যে শুরুটা হয়েছিল তা আর সঙ্গ ছাড়েনি। শিরায় ধমনীতে রক্তের সঙ্গে বয়ে গিয়েছে। সেই টানেই বারবার দিকবদল। দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা নাট্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা।
তাঁর ' বাঘ' নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বাঘ বলেছিল, ' এমন কাজ চাই যাতে কাজ হয়। আগুন জ্বলে ওঠে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। একটা মানুষের একটা কাজ। আগুন জ্বালা কাজ।'
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনদর্শনও ছিল যেন এমনটাই। বেঁচে থাকায়, কাজেও...