গোরা সর্বাধিকারী

“সঙ্গীতশিল্পী গোরা সর্বাধিকারী আমার অতি আপন। আমার বাড়ি তার-ই বাড়ি”। আত্মকথা লিখতে গিয়ে গোরা সর্বাধিকারী প্রসঙ্গে এমন কথা বলেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ থেকে আশি বছরেরও কিছু আগে, রবীন্দ্রপ্রয়াণবর্ষে- ১৯৪১ সালের ২৯ জুলাই  ঝাড়গ্রামে জন্ম গোরা সর্বাধিকারীর। সেখানে স্কুলজীবন শেষ করে বেলুড়  বিদ্যামন্দিরে পাঠগ্রহণ করেন। উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য জার্মানিতে যাবার সব আয়োজন করে বেড়াতে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে।  

নিয়তি কার জন্য কোথায় কোন আসনখানি পেতে রাখে তা কে জানে! লিখেছেন কণিকা, “শান্তিনিকেতন দেখতে এসে গোরা আটকে গেল এখানে। তখন সঙ্গীতভবনে ভর্তি চলছে। গোরা এসে আমাদের বলল সে ভর্তি হতে চায়। আমি আর শান্তিদা ওর গান শুনে সঙ্গীত ভবনে ভর্তি করে নিলাম। তখন পড়াশোনার জন্য জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল গোরার। জার্মানি যাওয়া আর হল না। গোরা শান্তিনিকেতনেই থেকে গেল”। শুধু থেকে গেলেন না। গোরা সর্বাধিকারী হয়ে উঠলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি কাছের জন। শিক্ষক- ছাত্রের বেড়া ভেঙে পৌঁছে গেলেন সুরসম্রাজ্ঞীর প্রীতিচ্ছায়াতলে।

লোকনিন্দার ঢেউ উঠেছিল । প্রথমে কানাঘুষো, পরে বেশ উত্তাল। কণিকা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। গোরার তো প্রশ্নই ওঠেনি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবনে গোরা সর্বাধিকারীর আগমনে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল কি? জানা যায় না।

আকস্মিক ভাবে সঙ্গীত ভবনে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন গোরা। তখন চিনতেনও না কণিকাকে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখে মনে হয়েছিল “কোথায় যেন ছবি দেখেছি……কোথায় যেন ছবি দেখেছি……. কোথায় যেন…… ভাবছি! মনে পড়ল, এইচ এম ভি-র পুজোর রেকর্ডের সঙ্গে গানের বইতে ছবি দেখেছি ওই সুন্দর মুখের মহিলার। উনিই মোহর। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভয় করতে লাগল। মোহরের সামনে রবীন্দ্রনাথের গান গাইব! তখন একটাই রবিঠাকুর জানতাম। ‘ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গাইলাম”। এক ইন্টারভিউতে গোরা বলেছিলেন যে তিনি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে গান শিখতেন। ভালো লাগত না রবীন্দ্রনাথের গান, এমনকি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানও রেডিয়োতে বাজলে রেডিয়ো বন্ধ করে দিতেন। সেই মানুষটির জীবন কাটল রবীন্দ্রনাথের গানে। যাঁর গানে রেডিয়ো বন্ধ করতেন তাঁরই  সুরের পথ ধরে।

সঙ্গীতভবন তখন জমজমাট। শান্তিদেব ঘোষ, সুশীল ভঞ্জচৌধুরী, বীরেন পালিত, ভি ভি ওয়াজেলওয়ার, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন- প্রমুখেরা গান শেখাতেন। এত সব গুণী শিক্ষকের মাঝেও কণিকার গানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন গোরা। ‘মোহরদি’-কে তাঁর মনে হত স্বভাবত স্বতন্ত্র- “মোহরদির গলায় গান যেন বিরামহীন আত্মদীক্ষার গান। কম হলেও অন্য গানও শুনেছি তাঁর গলায়। কিন্তু রবিঠাকুরের গানে ওঁর গলায় অদ্ভুত এক ‘মনকেমনের মীড় লেগে থাকত”। সেই ‘মনকেমনের মীড়’ এতটাই মন টেনেছিল অল্পবয়সি শ্রোতার যে তার আর ফেরা হল না।

গোরা সর্বাধিকারী শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯৬১ সালে। শান্তিনিকেতনে তখন এত বাড়িঘর, দোকানপাট, হোটেল ইত্যাদি ছিল না। আশ্রম এলাকায় গাড়ি চলাচল করত না। কণিকা তখন তাঁর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতেন বিশ্বভারতীর কোয়ার্টারে। ক্লাস নিতে আসতেন হেঁটে। তখন প্রায় সব শিক্ষক- শিক্ষিকাই হেঁটেই আসতেন। শিক্ষক হিসেবেও কণিকা ছিলেন অনন্য। কিন্তু গোরার কাছে তিনি নিছক শিক্ষক হয়ে ছিলেন না। তাঁদের সম্পর্ক চিরাচরিত শিক্ষক- ছাত্রের বাইরে পৌঁছে গিয়েছিল ব্যক্তিগত পরিসরে।

কি ছিল সেই সম্পর্ক? ছায়াসঙ্গী? সখ্যতা? কোন নামে বলা যায় চল্লিশ বছরের নিবিড়তাকে? নির্ভরতাকে? জীবনের প্রান্তে এসে আত্মকথা বলতে গিয়ে কণিকা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন একটি ঘটনার-“সে একটা দিন গেছে। গোরা সর্বাধিকারী আমার সঙ্গে যেত গ্রামোফোন কোম্পানিতে। মিস্টার পি কে সেন বললেন, ‘তুই এই ছেলেটাকে ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরিস কেন রে'? গোরার তখন খুব অল্প বয়স। বললাম, ও ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, ওর রেকর্ড করুন”। ভালো গান গাওয়া ছাত্রছাত্রীর অভাব ছিল না কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁরা অনেকেই ছিলেন তাঁর খুব কাছের।

কিন্তু গোরা সর্বাধিকারীই একমাত্র যিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে দূরে সরিয়ে কণিকাকে-ই করেছিলেন 'জীবনের ধ্রুবতারা’“তোমারেই করিয়াছি জীবনের  ধ্রুবতারা / এ সমুদ্রে আর কভু হবে নাকো পথহারা”। এ গান কি রেকর্ড করেছিলেন কখনও গোরা? খুব বেশি রেকর্ডও তো নেই তাঁর। কণিকা লিখেছিলেন, “গোরা প্রথম রেকর্ড করল,'পরবাসী চলে এসো ঘরে' আর ‘হাসি কেন নাই ও নয়নে’। সলিল চৌধুরী ছিল, বলল ‘আমি মিউজিক করব। তাই হল, সলিলের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতে মিউজিক রইল গোরার গানে”।

গোরা সর্বাধিকারীর সঙ্গে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন দ্বৈতকন্ঠের রেকর্ডও- “বিমান ঘোষ। সঙ্গীত জগতে একটি জনপ্রিয় নাম। আমার ও গোরার চারটি ডুয়েট গান উনি পরে বার করেছিলেন”। এভাবেই গোরা সর্বাধিকারীকে নিজের সুরের ধারায় যুক্ত করে নিয়েছিলেন কণিকা। যে জন্য তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে, “সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গোরা সর্বাধিকারীর নাম বিশেষ করে বলতে হয়। ওকে আমি বিশেষ বলছি, কারণ গোরার মতো আজ ৩৬ বছর ধরে একনাগাড়ে আমার সঙ্গে থেকে, আমার গান শুনে, শিখে এবং আমার গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ওর কান যা তৈরি হয়েছে, তা আর কোনো ছাত্রছাত্রীকে আমি দিতে পারিনি। সে শিক্ষক এবং গায়ক, দুই হিসেবেই আমার হাতে তৈরি”

জীবন বড় আশ্চর্যের। সে যে কোন বাঁকে কি দেখায় তা কে জানে! চেনা শব্দের কাঠামোয় ধরা পড়ে না জীবনের সব অভিজ্ঞতা। সম্পর্কগুলিও অনেকসময় চিরচেনা শব্দের আওতায় থাকতে চায় না, থাকেও না। থাকার প্রয়োজনও পড়ে না। কোনো দুটি মানুষের মধ্যে কোন রসায়নে কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর কেনই বা গড়ে ওঠে সে কথা আজও অজানা, হয়তো বা অজানাই থাকবে চিরকাল।

তবে সব আলোচনা, সমালোচনাকে তুচ্ছ করে গোরা সর্বাধিকারী থেকে গিয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়- বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য হয়ে। জীবনের শেষদিন অবধি কণিকার পরম নির্ভর হয়ে। সঙ্গীত ভবনের ছাত্র থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষ হলেন গোরা, কণিকা বিশ্বভারতীর কোয়ার্টার থেকে এলেন নিজের বাড়ি 'আনন্দধারা’-য়।

কিন্তু গোরা রয়ে গেলেন তাঁর ‘ধ্রুবতারা’-র কাছে। বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে। “দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া নিত্য কল্যাণ কাজে হে”- রেকর্ডে গেয়েছিলেন গোরা। নিত্যদিনের কাজে- অকাজে তিনি রয়ে গেলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিরসমর্পিতপ্রাণ হয়ে। ২০০০ সালে চলে গেলেন কণিকা। গোরা সর্বাধিকারী রয়ে গেলেন তাঁর 'মোহরদি’র স্মৃতি আগলে' আনন্দধারা’ বাড়িতে। কণিকার গানের ধারা ধরে রাখতে গড়ে তুললেন 'কণিকা ধারা’। তারপর  শেষের ডাক যখন এল তখন নিঃশব্দে চলে গেলেন তাঁর মোহরদির গানের সুরটি ধরে “দূরে কোথায় দূরে দূরে”। দিনটি ছিল ২০২২-এর ১৯ শেষ জানুয়ারি। শান্তিনিকেতনের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন গোরা সর্বাধিকারী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...