কুস্তিগীর পালোয়ান 'গোবর গুহ' আজও বাঙালির গর্বের পুরুষ। বাঙালি যে দুধুভাতু নয়, কুস্তির দাঁওপ্যাঁচ যে উত্তর ভারতের একচেটিয়া নয়, বিশ্বের কাছে বাহুবলে অপরাজেয় হয়ে থাকার পৌরুষ যে বাঙালিরও আছে, এটাই প্রমাণ করেছিলেন গোবর গুহ। পালোয়ানীতে বংশপরম্পরাগত ধারায় তিনি তৃতীয় পুরুষ। সোনার চামচ মুখে জন্মানো মানুষ।
আসলে গুহবংশে পালোয়ানীর ধারা শুরু হয় গোবরের পিতামহ অম্বিকাচরণ গুহের হাত ধরে। উনিশ শতকে কলকাতার মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের মস্ত ধনী ছিলেন তিনি। তাঁর শখ ছিল পালওয়ানীর। শুধু শখ না, অফুরান ভালোবাসাও ছিল। আর গায়ে ক্ষমতাও ছিল একেবারে ঐরাবতের মতো। তিনি নিজস্ব আখড়া বানিয়ে কুস্তিগিরিতে এমন নাম করলেন যে, পুরো ভারতবর্ষে মারাত্মক হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল।
অম্বিকার পর পালোয়ানীর ধারা রাখলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ক্ষেত্রচরণ। গোবরের জ্যাঠা। অম্বিকা নিজের হাতে তাঁকে তৈরি করেছিলেন। ক্ষেত্রচরণেরও খুব নামডাক হয়। কিন্তু ভদ্রলোক হঠাৎ অকালে মারা যাওয়ায় যেমন বেশিদূর এগোনোর সুযোগ পেলেন না, তেমনি অম্বিকার তৈরি ধারায় একটা শূন্যস্থানও তৈরি হয়ে গেল। গোবর তখন নিতান্তই বালক। কাজেই অম্বিকার ধারায় ছেদ পড়ার উপক্রম হতেই সেই ধারারক্ষায় উদ্যোগী হলেন স্বয়ং গোবরের পিতা রামচরণ।
রামচরণ অল্পবয়সে পিতার কাছে বেশ ভালোভাবেই কুস্তি শিখেছিলেন। কিন্তু ক্ষেত্রের মতো প্রতিযোগী হয়ে আখড়ায় নামেননি। এবার পুত্রকে তৈরি করতে আসরে নামলেন। বাবার শিক্ষা সম্বল করেই তিনি ছেলেকে শিক্ষিত করতে শুরু করলেন। দেশের বড় বড় আখড়ায় নিয়ে গিয়ে ওস্তাদ ওস্তাদ পালোয়ানদের লড়াই দেখিয়ে দারুণ উৎসাহ দিতে শুরু করলেন।
শেখাতে গিয়ে রামচরণ শুধু পুত্রের শরীরচর্চাতেই মনোনিবেশ করলেন না, তাঁকে গৃহশিক্ষক রেখে যথার্থ বিদ্যাশিক্ষাও দিতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে সে-সবের গন্ডিও একসময় পেরোলেন ভালোভাবে। এতে স্বভাবে চরিত্রে বংশগত আভিজাত্য যেমন রক্ষিত হল, তেমনি বৈদগ্ধ্যও বিকশিত হল।
মাত্র সতেরো-আঠারো বছর বয়স থেকে শুরু হল গোবর গুহের জয়যাত্রা। ১৯১০ সালে ইউরোপ জয় করে এলেন। ১৯১৩-তে স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত পালোয়ান জিমি ক্যাম্পবেলকে কুপোকাত করে স্কটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ হাসিল করে ফেললেন। তারপর ইউনাইটেড কিংডম চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করলেন। দুর্ধর্ষ জার্মান কুস্তিগীর কার্ল স্যাফ্টকে হারিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে তবে দেশে ফিরলেন।
এই সময় গোবর গুহ্কে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় তখন প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর বিস্ময়কর সব জয়ের বিমুগ্ধ বিবরণ, এই সময় থেকেই বিশ্বের কাছে তিনি এক অপরাজেয় মল্লবীর, বিস্ময় পুরুষ হয়ে উঠলেন। এভাবে তাঁর যে বিজয়রথ অগ্রসর হয়েছিল, যে গৌরব তিনি অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর সারাটা যৌবনকাল অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন। শেষ জীবন তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন নিজের আখড়ায় নতুন নতুন মল্লবীর তৈরিতে।
আসলে, 'গোবর' ছিল তাঁর ডাকনাম। তবে এই ডাকনামেই তাঁর নামডাক হয়েছিল। ভালো নাম, 'যতীন্দ্রচরণ গুহ'। সাহেবসুবোরা তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করতেন। ভালোবেসে ডাকতেন, 'গোবার গোহ' বলে। ডাকতেন, 'সজ্জন দৈত্য' বলেও।
কেননা, গোবর গুহের চেহারা ছিল দৈত্যের মতোই।ছ'ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা। ওজন প্রায় একশো কুড়ি কেজি।গলায় প্রায় আশি কেজির একটি হাঁসুলি পরে থাকতেন। দশ সের ও পঞ্চাশ সেরের দু'জোড়া বিশাল মুগুর ভাঁজতেন নিত্য। তারপরেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং মিষ্টভাষী মানুষ। বিদেশের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের ওপর বিশুদ্ধ ও ললিত ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে সকলকে যুগপৎ মুগ্ধ এবং চমৎকৃত করেছিলেন।
আসলে, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বঙ্গহিতৈষীরা যে আদর্শ বাঙালির স্বপ্ন দেখতেন, গোবর গুহ ছিলেন ঠিক তেমনই--স্বভাবে ললিত অথচ চরিত্রে দৃঢ়, প্রজ্ঞায় বিদগ্ধ অথচ বাহুতে অপরাজেয়...