অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন 'গীতামা'

নট সম্রাট শিশির কুমার ভাদুড়ির ছাত্রী। অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল শ্রীরঙ্গমে। আজ   স্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এক নাম তিনি। গীতা দে। কিন্তু একদিন অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন 'গীতামা'।

মঞ্চ জীবনে টেনেছিল খুব ছোটোবেলা থেকে। ছয় দশক ধরে তাঁর ধারালো অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। তেজি দজ্জাল, খল  চরিত্র দেখা গেলেও এই অভিনেত্রী কাঁদাতে জানতেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'ডাইনি' গল্প চলচ্চিত্র রূপ পেলে প্রধান ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সন্তান হারা মায়ের হাহাকার রাত জাগিয়ে রাখত দর্শকদের। 

ভীষন ভালো গান গাইতে পারতেন। চোখের কোণে হাসি ধরে রেখে সংলাপ বলার কৌশলে অনন্য।  তাঁর অগ্রজ অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের কথায় ' গীতা শক্তিশালী অভিনেত্রী। ঋত্বিক- সত্যজিৎ-তপন সিনহার ছবিতে দাপটে অভিনয় করেছেন। তাঁর মতো 'ক্যারেক্টার অভিনেত্রী' বাংলা ছায়াছবির জগতে দুর্লভ।

শুরু থেকেই সোজা-সহজ ছিল না তাঁর জীবনের পথ। তিরিশের দশকে উত্তর কলকাতার দর্জি পাড়ায় জন্ম তাঁর। বাবা তখনকার দিনের নামকরা ডাক্তার। গীতা যখন বেশ ছোট বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর বাবা-মা। গীতা মায়ের কাছেই থাকতে চাইলেন।

মা রেণুবালা নতুন জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু গীতা আর পিতার স্নেহ পেলেন না। অভাব হানা দিয়েছে জীবনে। তার তাড়নায় ছাড়তে হয়েছে পড়াশোনা। বয়স যখন মাত্র ছ’বছর সৎ বাবাই গীতাকে সিনেমায় নিয়ে এলেন।

ছোট্ট গীতার বাড়ির পাশেই থাকতেন বিখ্যাত গায়িকা রাধারানী দেবী।  বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক দেখে তাকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা।

 তাঁর সূত্রেই প্রবোধ গুহর সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলেন। সেই সময় পারিশ্রমিক পেতেন পাঁচ টাকা। সেই টাকাও সংসারে খরচ হয়ে যেত। তবু নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে যুঝছিলেন গীতা। যেই একটু তীরে উঠেছেন আবার এল আঘাত। মাকে হারালেন। বয়স তখন ১৪ কি ১৫।

প্রথম সিনেমায় সুযোগ পেয়েছিলেন ছ বছর বয়সে। ছবির নাম ‘আহুতি’। পরিচালক ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত টানা সিনেমা আর থিয়েটারে ব্যস্ত থেকেছেন। সেই সময়েই তালতলার ব্যবসায়ী অসীমকুমার দের সঙ্গে বিবাহ হয়ে যায়। বিয়ের পর বেশ কিছুটা দূরত্ব জমে অভিনয় জীবনের সঙ্গে। ফিরে আসেন ৫ বছর পর।

অভিনয় জীবনের এই পর্বে তাঁর পরিচয় হল নট সম্রাট শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। তাঁর কাছে নাড়া বাঁধলেন। থিয়েটার জীবনেও এলো নতুন স্রোত। শম্ভু মিত্র, তুলসী লাহিড়ি, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, কানু বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৫৬ থেকে একটানা ১৮ বছর ছিলেন স্টার থিয়েটারের নিয়মিত অভিনেত্রী।

সঙ্গে সমানতালে বাংলা ছবিতেও। ব্যক্তিগত জীবনের তোলপাড় তাঁর ছবির জীবনে ছায়া ফেলতে পারেনি। তাঁর ছবিতে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত খুব সাদরে গ্রহণ করেনি স্বামীর পরিবার। যত যন্ত্রণা পেয়েছেন পর্দায় তত ধারালো হয়ে উঠেছেন। পার্শ্বচরিত্র হয়েও তিনি নিজের আলোয় উজ্জ্বল।

জীবনের পথ তাঁর আজীবন মন্থর। শেষ জীবনেও অপরিসীম দারিদ্র্য আর অসহয়তা তাঁর সঙ্গী। কিন্তু মানুষ তাঁকে যতই ভাঙনে আনুক তিনি বারবার কূল খুঁজে পেয়েছেন সিনেমার কাছেই।       

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...