দেশ তখনও পরাধীন, গঙ্গানগর তখনও বিকানীর স্টেটের ছোট্ট একটি শহর। সেই সময় সর্দার অমর সিং ধীমান চাকরিসূত্রে সুদূর পাঞ্জাব থেকে এই শহরে এসে বাসা বাঁধলেন। বিয়ে করলেন বচ্চন কৌরকে। তাঁদের অনেক সন্তানের মাঝে ১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জন্ম হল আরও এক পুত্রসন্তানের। অমর সিং সেই ছেলের নাম রাখলেন, জগমোহন সিং ধীমান। বাসা থেকে খানিক গেলেই গুরুদ্বারা। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একদিন অমর সিং সেখানে গেলেন তাঁর দীক্ষাগুরুর দর্শনে। গুরুজির দর্শন পেল ছোট্ট জগমোহন। গুরুজিও দেখলেন জগমোহনকে। দু'জনের এই দেখা শুধু সাজদা-আশীর্বাদে শেষ হল না। এ-দেখায় গুরুজির সঙ্গে যেন ভবিষ্যতের দৃষ্টিবিনিময় হল। তাঁর ঠোঁটে খেলল প্রসন্নতার হাসি। অমর সিং-কে বললেন, ছেলে তোমার কিন্তু সাধারণ নয়, একদিন দেখবে এই ছেলে জগতকে মোহিত করে তাকে জয় করে নেবে। তাই এর নাম রেখো, ‘জগজিৎ’। সেই থেকে ‘জগমোহন’ হয়ে গেলেন 'জগজিৎ'।
বাবা চেয়েছিলেন জগজিৎ বড় হয়ে হয় ইঞ্জিনিয়ার হোক, নইলে হোক বড় কোন সরকারি চাকুরে। ছেলে বড় হয়ে আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে সুখে জীবন কাটাবে, বাবামায়েরা এটাই তো চান। অবশ্য তখন বিধি বলছিল অন্যকথা। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে বাবার বরাবরের দুর্বলতা। তিনি চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েরা পড়াশুনোর পাশাপাশি গানবাজনাও শিখুক। তাই অন্য ভাইবোনদের মতো জগজিৎকেও স্কুলের পড়ার পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের তালিম নিতে যেতে হত পন্ডিত ছগনলাল শর্মার বাড়িতে।
পড়তে জগজিৎ-এর একেবারেই ভালো লাগত না। ধীরে ধীরে সঙ্গীতই তাঁর প্রাণের সখা হয়ে উঠছিল। ক্লাসিক্যাল যেমন ভালো লাগত, তেমনি ভালো লাগত পাঞ্জাবি ফোক, টপ্পা আর তখনকার সিনেমার গান। সিনেমা আর সিনেমার গান বাবার অবশ্য একেবারেই পছন্দ ছিল না। শুধু বাবা কেন, তখন যারা ক্লাসিক্যাল চর্চা করতেন, তাঁদের কেউই এ-জিনিসটিকে খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। কিন্তু, সিনেমার প্রতি বালক জগজিৎ-এর ছিল অদম্য এক আকর্ষণ। লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে বাবার হাতে একদিন ধরা পড়লেন। কপালে জুটল উত্তম-মধ্যম। আর সিনেমার গান গাইতে গিয়ে কপালে জুটল গুরু ছগনলালের খড়ম। তবু, সে-যুগের সিনেমার গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা একচুলও কমেনি। পরে তাঁর সেই ভালোলাগা গানগুলো নিজের কন্ঠে নিজের শৈলীতে রেকর্ড করেছিলেন জগজিৎ।
জলন্ধরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবার আগেই গুরু ছগনলালের পাঠশালায় ক্লাসিক্যালের পাঠ শেষ করে ওস্তাদ জামাল খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিতে শুরু করলেন খেয়াল-ঠুংরি ধ্রুপদ সঙ্গীতের। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ হল না। অন্তরে বোম্বের ডাক শুনলেন। বাড়িতে কাউকে কিছু না-জানিয়েই বোম্বে গেলেন। লড়াই করলেন, কিচ্ছু হল না। রেস্ত শেষ হল, বাড়ি ফিরলেন।
প্রথম সফরে ব্যর্থ হলেন বটে, কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিলেন না। ১৯৬৫-তে আবার চেপে বসলেন পাঠানকোট এক্সপ্রেসে। পৌঁছলেন বোম্বে। এবারও পকেটে পয়সা নেই। কিন্তু, এবার সঙ্গে আছে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রস্তুতি। একটু সুযোগের আশায়, যোগাযোগের আশায় আর দু’বেলা পেট ভরে খাবার আশায় পার্টিতে, জলসায় ফিল্মি গান, গজল আর পাঞ্জাবি টপ্পা গাইতে শুরু করলেন। এমনি চলতে চলতে একদিন যোগাযোগ হল এইচ এম ভি’র সঙ্গে।
ভাগ্যের তরী ঘুরতে ঘুরতে এবার যেন ঠিক ঘাটে এসে ভিড়ল। ১৯৬৬-তে এইচ এম ভি-থেকে একটি ইপি-র একপিঠে দুটো গান গাওয়ার সুযোগ এল। তাতে গাইলেন ‘আপনা গম ভুল গয়ে’ আর ‘আঁখ কো জাম সমঝ বৈঠা থা’। গান দুটি খুবই জনপ্রিয় হল। গজল গায়ক হিসেবে শ্রোতার মনে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন জগজিৎ। বুঝলেন এটাই তাঁর পথ।
১৯৬৭-তে গজলগায়ক রাজেন্দ্র মেহতার একটি গানে প্রথম সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ হল জগজিৎ-এর। শুরু হল গজল গানের ক্ষীয়মাণ ধারাটিকে এ-যুগের শ্রোতার কাছে এ-যুগের উপযোগী করে পরিবেশন করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তিনি গজলের মেজাজটিকে অক্ষুন্ন রেখেও তারমধ্যে ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহার বাড়ালেন, এমনকি প্রিল্যুডের পরিবর্তে কোথাও কোথাও কোরাস ব্যবহার করলেন, সহজ কথায় গভীর ব্যঞ্জনা আছে যেসব গজলে, গাইতে গিয়ে সেগুলো নির্বাচনের কথা মাথায় রাখলেন। তাঁর আগে চেনাছক ভেঙে এমনটা ভাবার সাহস করেননি কেউ। তাই কপালে পুরাতনপন্থীদের কুৎসা আর নিন্দামন্দও কম জুটল না। এসব সত্বেও জগজিৎ তাঁর নিজস্ব গায়কী আর আত্মার সঙ্গে আত্মাকে জুড়ে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতায় শ্রোতার হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিলেন। একমাত্র তিনিই মেহফিলের গজলকে নিজের করে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। তাই বোধহয়, তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধু গুলজারসাহেব তাঁকে ‘গজলজিৎ জগজিৎ’ বলতেন, আর আমরা বলি, ‘গজলসম্রাট জগজিৎ’।