ফরিদপুর আর সিরাজগঞ্জ। পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্র। সড়কপথে দুই শহরের মাঝখানের দূরত্ব ৫ ঘন্টা। আপাতভাবে দুই লোকালয়ের দূরত্ব অনেক। অমিলও অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের এই দুই জনপদকে এক সূতোয় বেঁধে দিল ১৯৫৭ সাল। আরও স্পষ্ট করে বললে ফরিদপুরের রায় চৌধুরি পরিবার আর সিরাজগঞ্জের দাশগুপ্ত পরিবারকে। সিরাজগঞ্জ তখনও পাবনা হয়নি।
কীভাবে ইতিহাসের পাতায় এক সূত্রে বাধা পড়ল এই পরিবার?
সে কথা জানতে গেলে হাঁটতে হবে ১৯৫৭ সালে। টালিগঞ্জ পাড়ায় ধীরে ধীরে জমি শক্ত করছে উত্তম-সুচিত্রা জুটি। দর্শকরা ভাসছেন সেই আবেগে। এই সময়েই ছবি প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নিলেন উত্তমকুমার। ১৯৪২-এ মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত ইংরেজি ছবি ‘র্যান্ডম হার্ভেস্ট’ ছবির অনুকরণে বাংলায় হবে ‘হারানো সুর’। পরিচালনায় অজয় কর।
ছবিতে প্রধান পুরুষ চরিত্রে উত্তমকুমার। এক দুর্ঘটনায় স্মৃতি নষ্ট হয় তার। ছাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি বহু যত্নে-শুশ্রুষায় ফিরিয়ে আনে এক মহিলা চিকিৎসক। পরে সেই চিকিৎসক হয় তার প্রেমিকা-স্ত্রী। কিন্তু অতীত ফিরতেই রোগী ভুলে যায় বর্তমানকে। সেই চিকিৎসকের ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। সেভাবেই তারা প্রেমে পড়ে একে অপরের। উত্তম-সুচিত্রা জুটির অভিনয় যদি এই ছবির প্রধান আকর্ষণ হয়, দ্বিতীয় আকর্ষণ অবশ্যই ছবির গান। শিমুল গাছের তলায় বসে সুচিত্রা গাইছেন ‘কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার’ এই এক গানেই আপ্লুত হয়েছিল দর্শকরা। সে কণ্ঠের কী যে আবেদন! ছবি শেষ হয়ে যায়, হল থেকে বেরিয়ে আসে দশক, কিন্তু কানে-মনে চলতে থাকে সেই গানের অনুরণন।
এই গানই মিলিয়ে দিয়েছিল ফরিদপুর আর সিরাজগঞ্জকে। গানটি গেয়েছিলেন ফরিদপুরের ভূমিকন্যা গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী। আর লিপ দিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন। গীতা ঘোষ রায়চৌধুরীই পরে হয়ে ওঠেন গীতা দত্ত। পরবর্তী সময়ে সুচিত্রার লিপে আরও বহু গান পেয়েছিলেন গীতা দত্ত।
ফরিদপুরের বর্ধিষ্ণু জমিদার পরিবার। দেশভাগের পর ভূমি-সম্পদ হারিয়ে পুরো পরিবারটিকে চলে আসতে হয় প্রায় অচেনা ভূমিতে। তখন একমাত্র সম্পদ বলতে কন্যা গীতার কণ্ঠ। সেই জোরে চলে আসেন বোম্বাই। তারপরের কাহিনিতে জিত যেমন আছে তেমন হারও কম নেই। ব্যক্তিগত জীবনের হার তিনি ভুলতে চাইতেন সুর আর নেশায়। তবে সুর তাঁকে হারতে দেয়নি কোনওদিন। প্রতিবার প্রতি গানে জয় করেছেন আসমুদ্র হিমাচলের হৃদয়।
এখানেও সুচিত্রা-গীতায় অসম্ভব মিল। পায়ের তলায় জমি আর নিজের আত্মপরিচয় নিজে তৈরী করার লড়াই তাঁদের বেঁধেছিল এক সুতোয়। শুধু মাধ্যমটা আলাদা।