দুই ভাই। মাঝখানে তিন হাত ব্যবধান। ছবি আঁকতেন। রং-তুলিতে মগ্ন মৈনাক। ছায়া পড়ত লাল মেঝের বারান্দায়। ক্যানভাসের সান্নিধ্যে ডানা মেলত ভাবনারা। নিবিড় হয়ে। শিল্প আর শিল্পী একাকার। মাঝখানে আর কেউ নেই।
এভাবেই কেটে যেত দিনের পর দিন। পারিবারিক স্বতস্ফূর্ত শিল্প প্রবাহের ধারায় পুষ্ট হয়েছিলেন দু’জনেই। কিন্তু দু’জনেই শিল্প সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। আঁকার রীতি এবং বিষয়ে কোনও মিল নেই। যেমন মিল নেই তাঁদের পরিচিতিতে ও জনপ্রিয়তাতেও।
অবনীন্দ্রনাথ ‘শিল্পগুরু’। গগনেন্দ্রনাথ যেন চির আড়ালে থাকা এক নিমগ্ন শিল্পী। ধরা বাঁধা পদ্ধতিতে শিল্পশিক্ষা তিনি কোনওদিনই নেনেনি। তিনি রং-তুলি হাতে নিয়েছিলেন নিজের খেয়ালখুশির টানে। কখনও শোক ভুলতে।
প্রিন্স দ্বারকানাথের প্রপৌত্র। গুণেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান। মা সৌদামিনী।
গুণেন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথকে ছোট থেকে বড় করেছিলেন একেবারে অন্যরকমভাবে। ঠাকুরবাড়ির বিলাসব্যাসানের ছাপ যাতে শিশু মনের ওপর না পড়ে তার চেষ্টা ছিল সারাক্ষণ।
আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি বারির ছেলে যেভাবে স্কুলে যেত সেসময় তিনিও ঠিক সেভাবেই স্কুলে যেতেন।
পড়তেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। সেখানে অন্য পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে ছবি আঁকার সুযোগও ছিল। গগনেন্দ্রের আগ্রহ ছিল রং-তুলিক্যানভাসে। তিনি ছবির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
তবে শিল্পচর্চার দুনিয়ার থেকেও একটা সময় বড় হয়ে উঠেছিল সংসারের দায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারান। তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র। তাই সংসার সামবার গুরুভার এসে পড়ে তাঁরই কাঁধে। জীবন মোড় নেয় একেবারে অন্যদিকে।
কিন্তু সেই জীবনই আবার তাঁকে ফিরিয়ে দেয় ক্যানভাসের কিনারায়। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে।
ছেলে গেহেন্দ্রের বিয়ে দিয়েছিলেন ধুমধাম করে। বাজনা-বাদ্যিতে হইহই জোড়াসাঁকোবাড়ি। কিন্তু আলো রোশনাই বেশিদিন রইল না। মাত্র একমাসের মধ্যে গেহেন্দ্র চলে গেল টাইফয়েডে।
পুত্রশোকে টালমাটাল মন। কাতর পিতা বিষাদরুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় খুঁজে পেলেন আধ্যাত্মবাদে। সেই পথ দিয়েই ফিরে এলেন রং-তুলির দুনিয়ায়।
নির্সগ এসেছে তাঁর ছবিতে। এসেছে নাগরিক জীবন। গ্রাম জীবন। জাপানি শিল্পীদের সংস্পর্শে তাঁর মন টেনেছিল জাপানি শিল্পকলা। গগনেন্দ্রনাথকেই তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে অলংকরণের দায়িত্ব দেন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর তুলিতে নশ্বর হয়ে উঠেছিল জোড়াসাঁকো অন্দরমহলের হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যরা।
তবে তিনি জাত চিনিয়েছিলেন ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে। রামানন্দ নিয়মিত গগনেন্দ্রনাথেৱ হাস্যরসাত্মক চিত্র প্রবাসী ও মডার্ণ রিভিউ-তে প্রকাশ করেছেন। রামানন্দই ছিলেন গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গাত্মক ছবির প্রধান অনুপ্রেরণাদাতা। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গাঁধী— কেউ বাদ নেই!
পাশ্চাত্য শিল্প নিয়ে চর্চা করতেন নিয়মিত। দেশি-বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে চলত আলোচনা। নিজেও পরীক্ষা-নিৃক্ষা কম করতেন না।
‘কিউবিক’ধারা নিয়ে আলোছায়ার পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন। তাঁর সেই পরীক্ষার ছাপ পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র প্রচ্ছদে।
জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বহু দিকে। বহু রকম কর্মে। স্বদেশোভিমান ও ছকভাঙ্গা মানসিকতাতেও তিনি অন্যরকম।
ভারতীয় শিল্পকলার ভুবন তাঁকে ভুলেছে, কিন্তু আশির দোরগোড়ায় পৌছে রঙ-তুলি হাতে নিয়ে পরামর্শের জন্য তাঁকেই চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘‘আমার ছবির নেশা আজও কাটল না। ...তোমরা কাছে থাকলে ভরসা পেতুম, কোন রাস্তায় চলছি সেটা তোমাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারতুম।’’