ব্রিটিশ শৃঙ্খলে ভারতবর্ষ তখন বন্দী। প্রেসিডেন্সি কলেজে এক ব্রিটিশ অধ্যাপক মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন। ভাষণের প্রত্যেকটি শব্দে শুধুই বিদ্বেষ। বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা।
সহ্য করতে পারলেন না এক ছাত্র। তাঁর রক্ত গরম হয়ে উঠলো। নিজের দেশ জাতির সম্বন্ধে কোনো কটু কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাও অপেক্ষা করছিলেন সেই সম্মানীয় অধ্যাপক যদি নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কথাগুলো ফিরিয়ে নেন। তা তো হলোই না, উল্টে আরো কটু কথা শোনালেন তিনি তৎকালীন সমাজের সমস্ত বাঙালি দেশপ্রেমিকদের।
ব্যাস আর পারলেন না সেই ছাত্র। সজোরে নিজের জুতো দিয়ে আঘাত করেছিলেন সেই অধ্যাপককে।
পরিনাম?
ব্রিটিশ ভারতবর্ষে তখন এমন ঔদ্ধত্যের শাস্তি ছিল শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া। কিন্তু সেই ছাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজের কর্তৃপক্ষকে এই সুযোগ দিলেন না। নিজেই ত্যাগ করলেন কলেজ।
যোগদান করলেন বিপ্লবী সংগঠনে। শপথ নিয়েছিলেন দেশের মুক্তির। ব্রিটিশ অত্যাচারকে ধ্বংস করে স্বাধীন ভারতকে নতুন সূর্য দেখানোর ব্রত ছিল এই বিপ্লবীর।
উল্লাসকর দত্ত। ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল জন্ম ত্রিপুরার কালিকচ্ছে। পিতা দ্বিজদাস দত্ত।
বাবা ছিলেন বৈদিক সাহিত্যের পন্ডিত। তাই চেয়েছিলেন ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করে অধ্যাপনা করুক।
কিন্তু প্রেসিডেন্সির অধ্যাপককে অপমানের ফলে শাস্তি পেয়ে উল্লাসকর দত্ত চলে যান মুম্বাইতে।
গীতা পাঠ, যোগাভ্যাসের মাধ্যমে নিজেকে পরিপূর্ণ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে ফিরে আসেন বাংলায়।
দিকে দিকে তখন ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন অভিজ্ঞ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে হেমচন্দ্র দাসের নাম বিশেষভাবে পরিচিত ছিল সে সময়। উল্লাসকর এসে আলাপ করলেন তাঁর সঙ্গে।
মুরারীপুকুরের একটি বাগান বাড়িতে সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ অভিযান এর আগে বোমা তৈরি করা হত। কিন্তু কিভাবে যেন এই খবর পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে।
বিপ্লবী বারীন ঘোষের সামান্য অসাবধানতায় সেদিন ওই বাগানবাড়ি থেকে ধরা পড়েছিলেন পঁচিশ জন বিপ্লবী। উল্লাসকর দত্ত ছিলেন সেখানে।
আলিপুর বোমা মামলায় তাঁর ফাঁসির আদেশ দিল ব্রিটিশ সরকার। কোন প্রতিবাদ না করেই সেই আদেশ মেনে নিয়েছিলেন নির্ভীক এই মানুষটি।
তিনি ও বারীন ঘোষ বন্দী ছিলেন একই জেলে। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হচ্ছিলেন বারীন ঘোষ। মূলত তাঁর অসতর্কতায় উল্লাসকর দত্তের মত এরকম একজন সাহসী দেশপ্রেমিক ফাঁসির দড়ি গলায় পরবে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই বারবার তাঁকে অনুরোধ করছিলেন ফাঁসির শাস্তি মকুব করার জন্য আবেদন করতে।
উত্তরে উল্লাস বলেছিলেন ''আপিল আবার কি করিব যার কোর্টই মানি না, তার আবার আপিলই বা কি আর বিচারই বা কি"?
এভাবেই নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন উল্লাসকর।
কিন্তু অন্যান্য বিপ্লবীরাও আপিল করছিলেন ফাঁসি মকুবের জন্য। অবশেষে পরিবারের মানুষজন এবং বারীন ঘোষের চাপে পড়ে উল্লাসকর আবেদন করলেন ফাঁসি মকুবের।
তাঁর শাস্তি হল আন্দামানে দ্বীপান্তর।
কিন্তু সেখানেও চলল নিগ্রহ।
উল্লাসকর দত্ত তাঁর 'কারাজীবনী'তে লিখেছিলেন এই কালাপানিতে থাকার সময় বারবার তাঁর মনে পড়ত কৈশোরবেলার প্রেমের কথা।
বিপিনচন্দ্র পালের সেজ মেয়ে লীলার সঙ্গে প্রেম ছিল তাঁর।
কিন্তু সক্রিয় বিপ্লবীদের সংসার শুধুই তাঁদের দেশ।
তাই দুজনেই নিজেদের অনুভূতিকে অন্তরের গোপন কুঠুরিতে আটকে জীবনের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে আন্দামানের সেলুলার জেলে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এই বিপ্লবী। কিন্তু কোন এক অলৌকিক শক্তি তাঁকে আটকে দিচ্ছিল। এমন কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন।
তিনি লিখেছেন ''যেন এক শ্বেত বিন্দু সাহেব কর্মচারীর শরীরের এক পাশ হইতে অপর পাশে চলিয়া গেল"।
বারবার তাঁর মনে হতো, ধ্বংস নয়, মৃত্যু নয়, কোনো সৃষ্টি অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য।
১৯২০ সালে আন্দামান জেল থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল একটি মানসিক স্বাস্থ্য-নিবাসে।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর সত্যিই এক সৃষ্টি তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিল। ভালবাসা।
বিপিনচন্দ্র পালের সেই কন্যা। বিধবা, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। নিজের ভালবাসা দিয়ে তাঁকে শেষ কয়েকটা বছর আগলে রেখেছিলেন উল্লাসকর দত্ত।
১৯৪৮ সালে ৬৩ বছর বয়সে ছোটবেলার সেই প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। আক্ষরিক অর্থে অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে সেভাবে সংসার করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যে কটা দিন তাঁকে কাছে পেয়েছিলেন, ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউই তাঁর খোঁজ রাখেনি। বিয়ের পর আসামের শিলচরে থাকতেন তিনি। কিন্তু অন্তরে অসম্মানের ক্ষত বাসা বেঁধেছিল। তাই সরকারি ভাতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ভাঙ্গা-গড়া মিলিয়ে তাঁর জীবন ছিল সাহিত্যের মত। তবে নিজের আদর্শ থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি।
আন্দামানের ডেপুটি কমিশনার সাহেব বলেছিলেন "Ullaskar is one of the noblest boys I have ever seen, but he is too idealistic."