বাংলার বিপ্লবে বোমার প্রবর্তক হেমচন্দ্র কানুনগো

এমনটা হওয়ার কথা ছিল না; কিন্তু এটাই সত্যি যে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত দেওয়া-রক্ত নেওয়া বাংলার বিপ্লবীদের বেশিরভাগের নামই আজ অনালোচনার ধুলোয় মলিন। তেমনই একজন, হেমচন্দ্র কানুনগো। ধুলো সরিয়ে আজ বলব তাঁরই গল্প...


গল্পটার প্রেক্ষাপট গত শতকের গোড়ার দিক। সেই সময় একের পর এক গুপ্ত-সমিতি গড়ে উঠছিল বাংলা এবং ভারতের নানান প্রদেশে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহিংস বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই সমিতিগুলোর বড় রকমের অবদান রয়েছে।


উনিশ শতকের শেষদিকে ইওরোপের নানান দেশে ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল নানান গুপ্ত সমিতি। শোষক শাসকের বিরুদ্ধে তাদের কিছু কিছু সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ভারতের স্বাধীনতাকামী অনেক তরুণকেই সেদিন উদ্বুদ্ধ করেছিল। মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র কানুনগো ছিলেন এঁদেরই একজন। 


বিদেশি অনুপ্রেরণাতে শুরু হলেও বাংলার গুপ্ত সমিতিগুলোর আদর্শ কিন্তু হয়ে উঠেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় 'আদর্শ' নির্দিষ্ট হলেও সেই 'আদর্শ'-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন সত্যানন্দের খুব অভাব ছিল। অবস্থা যখন এমন, ঠিক তখনই হেমচন্দ্র কলকাতায় এসে যোগ দিলেন বারীন ঘোষের 'অনুশীলন সমিতি'তে। 


বারীন ঘোষ একদিকে জাতীয়তাবাদী পত্রিকা ‘যুগান্তর’ প্রকাশ করে কখনও সাহিত্যের মোড়কে, কখনও বা ধর্মালোচনার আড়ালে ইংরেজের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রবল জনমত তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন; অন্যদিকে গোপনে গোপনে ঘটিয়ে চলেছেন অনুশীলন সমিতির সাংগঠনিক বিস্তার, যাতে দেশে আশু একটা বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলা যায়--তরুণদের মধ্যে এমন একটা ধারণা বেশ জাহির করে চাউর করার ব্যবস্থা হয়েছিল সেই সময়।


কিন্তু, হেমচন্দ্র এসে দেখলেন যে, সমিতির কার্যকলাপ শুধুই প্রচার, সদস্য সংগ্রহ, চাঁদা আদায় এবং দু’একটি রিভলবার সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতে আর যাই হোক ব্যাপক আকারে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। 


শুধু অন্ধভাবে আঁকড়ে থাকা নয়, আসল পরিস্থিতি বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য হেমচন্দ্র দেশের নানান প্রদেশের গুপ্ত সমিতির ভেতরের খবর নিতে শুরু করলেন, সেখানে গিয়ে সরেজমিনে সবটা জানার চেষ্টা করলেন। এতে তাঁর কাছে কয়েকটা সত্য একেবারে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল।

Hemchandra

হেমচন্দ্র বুঝলেন যে, একমাত্র নাসিকের একটি গুপ্ত সমিতি ছাড়া আর কোথাও তেমন কাজের কাজ হচ্ছে না। অধিকাংশ সমিতিই হয় নিছক আধ্যাত্মিকতার, নয়তো ব্যায়াম ও লাঠি খেলার আখড়া হয়ে উঠেছে। এতে আর যাই হোক-না-কেন, দেশোদ্ধার হবে না। নিজেদের অস্ত্রের ভাণ্ডার বাড়িয়ে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এগোতে না-পারলে বিশাল ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় রকমের বিপ্লব বা আন্দোলন গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয়।

এই রকম এক অবস্থায় হেমচন্দ্র ঠিক করলেন যে, তিনি বিদেশে যাবেন। এবং, সেখানকার গুপ্ত সমিতিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাজের পদ্ধতি নিজের চোখে দেখে আসবেন। তাছাড়া, বোমা ও নানান অস্ত্রশস্ত্র বানানোর কৌশলও শিখে নেবেন। আর তার জন্য তিনি কারও কাছে কোন অর্থ সাহায্য নেবেন না।

আসলে, দিকে দিকে গজিয়ে ওঠা অজস্র গুপ্ত সমিতি দেশের নামে যেভাবে চাঁদা আদায় করে দেশবাসীকে প্রবঞ্চনা করছিল এবং নেতারা সে-টাকা নিজেদের ইচ্ছেপূরণের মোচ্ছবে ব্যবহার করছিল--এই সত্যটাই তাঁকে জনগণের কাছ থেকে টাকা তোলার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। ফলত, তিনি মেদিনীপুরস্থ নিজের ঘরবাড়ি বিক্রি করে সেই টাকায় ইওরোপ পাড়ি দিলেন। 

এভাবেই একদিন তিনি পৌঁছে গেলেন প্যারিসে। সেখানে যোগাযোগ হল নৈরাজ্যবাদী জোসেফ অ্যালবার্ট, এম্মা গোল্ডম্যান এবং আর-একজন রহস্যময় অজ্ঞাত পরিচয় রাশিয়ানের সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে শিখে নিলেন বোমা তৈরির কৌশল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরণের বোমা তৈরির ওপর রুশ ভাষায় লেখা বইও তিনি অনুবাদ করে নিলেন। 

সে-সব শিখে সেখানকার গুপ্ত সমিতিগুলোর কার্যকলাপ ও তার ধরণধারণ সম্পর্কে বিস্তৃত জানতে শুরু করলেন, যাতে সেই পদ্ধতি প্রয়োজনে স্বদেশে এসে সদ্ব্যবহার করা যায়। 

কিন্তু না, এ-ব্যাপারে তাঁকে অত্যন্ত নিরাশ হতে হল। গভীরে ঢুকে তিনি অচিরেই বুঝলেন যে, স্বদেশের গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপের সঙ্গে বিদেশের গুপ্ত সমিতিগুলোর ঐতিহ্য ও আইডিয়াগত কোনদিনও কোন মিলমিশ করানো যাবে না। সেখানকার সমিতিগুলো নামেই 'গুপ্ত', এ-দেশের মতো কাজে নয়। কাজেই, আর দেরি না-করে তিনি ফিরে এলেন দেশে।

দেশে ফিরেই হেমচন্দ্র বিপ্লবীদের হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন বোমা তৈরির ম্যানুয়াল; নিজে তো বোমা তৈরি করলেনই। তাঁর তৈরি বোমা নিয়েই ক্ষুদিরাম বসু গেলেন কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। যদিও সে-হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হল। 

তবুও, বারীন ঘোষের চেষ্টায় ভবানীপুরের একটি বাড়িতে গড়ে উঠল বোমা তৈরি শেখানোর স্কুল, আর তার শিক্ষক হলেন হেমচন্দ্র। অল্পদিনের মধ্যে শাসকের তৎপরতায় স্কুল উঠে গেল বটে; কিন্তু এই সত্যটুকু রয়ে গেল যে, বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের হাতে তিনিই প্রথম তুলে দিলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার অপেক্ষাকৃত আধুনিক এক অস্ত্র--'বোমা'...


তথ্যঋণ : 'বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা'--হেমচন্দ্র কানুনগো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...