আবিষ্কৃত প্রতিভা দেবকীকুমার বসু

ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সিনেমার জগতে সুবিখ্যাত ছিলেন 'ডি জি' নামে। নির্বাক থেকে সবাক, দুই যুগেরই স্বনামধন্য অভিনেতা-পরিচালক-চিত্রনাট্যকার-প্রযোজক। ১৯২১ সালে তাঁর রচিত-অভিনীত-নির্মিত 'বিলেত ফেরৎ' ছবিটি বাঙালি টেকনিশিয়ান ও প্রযোজক দ্বারা নির্মিত, বাঙালি অভিনীত ও বাঙালি প্রদর্শিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের মর্যাদা নিয়ে ইতিহাস হয়ে রয়েছে। অথচ ১৯২৭ সাল নাগাদ এই ধীরেন্দ্রনাথই দাগা খেলেন 'কিনেমা আর্টস' সিনেমা কোম্পানির কাছে। এ-বছর দারুণ খেটেখুটে 'শঙ্করাচার্য্য' ছবিটি তিনি এই কোম্পানির হয়ে বানালেন বটে; কিন্তু, ছবি রিলিজের আগে মনোমালিন্য হওয়ায় কোম্পানি তাঁকে বরখাস্ত করল। শুধু তাই নয়, ছবিটির টাইটেল কার্ড-এর কোথাও তাঁর নাম অব্দি রাখল না। সব মিলিয়ে দারুণ অপমানিত হলেন ধীরেন্দ্রনাথ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন আর কোন কোম্পানির পদানত হয়ে কাজ করবেন না, নিজেই কোম্পানি তৈরি করবেন। ফলে, গোড়াপত্তন হল, 'দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি'-র।

কোম্পানি তো হল, কিন্তু টাকা কই? টাকা ছাড়া তো ছবি তৈরি করা যাবে না। ফলে, কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের তোড়জোড় শুরু করলেন ধীরেন্দ্রনাথ। চলল বড়লোকদের বাড়িতে কড়া নাড়া। এই কড়া নাড়ার জন্যই তিনি বর্ধমানের শক্তিগড়ে হাজির হলেন একদিন। তাঁকে অবশ্য কড়া নাড়তে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এক বন্ধু, ডাক্তার সেন। আশা দিয়েছেন যে, বেশ কয়েকজন বড়লোকের কাছে কিছু শেয়ার বিক্রি করিয়ে দেবেন। সুতরাং, স্বস্থানে ডেকে ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথকে আশাহত হতে দিলেন না, কথা রাখলেন। সঙ্গে একটি বিশ্বস্ত ছেলেকে দিয়ে তাঁকে পাঠালেন বড়লোকদের বাড়িতে বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতে সত্যিই বেশকিছু শেয়ার বিক্রি হয়ে গেল। ধীরেন্দ্রনাথ বেশ খুশি হলেন। এবার মনোযোগ দিলেন সঙ্গের ছেলেটির দিকে। মাথায় বাবরি চুল, সুদর্শন মুখ। ধীরে ধীরে কথা বলা তার অভ্যেস। স্বভাবে নম্র। বয়স বছর তিরিশ। কিন্তু, চেহারার লালিত্যে মনে হয় যেন পঁচিশ-ছাব্বিশ। সবচেয়ে বড় কথা, কাজের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। ছেলেটি কলেজে পড়েছে। গান্ধীপন্থী। পড়তে পড়তেই গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে। এখন অবশ্য শক্তিগড়ের 'শক্তি' নামের একটি ছোট্ট পত্রিকার সম্পাদক। গল্প লেখার অভ্যেস আছে এবং দারুণ লেখে। নতুন কোম্পানিতে এমন ছেলের বড্ড প্রয়োজন। কথা বলে দেখলেন, সিনেমার প্রতি ছেলেটিরও অগাধ টান। ফলে, ধীরেন্দ্রনাথ কিছুতেই তাকে হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ না-দিয়ে সটান সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কলকাতায়। বলা বাহুল্য, ছেলেটির নাম, দেবকীকুমার বসু। এবং, তিনি সম্পূর্ণভাবেই ধীরেন্দ্রনাথের আবিষ্কার।

'দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি'-র প্রথম ছবি তৈরির তোড়জোড় শুরু হল। ধীরেন্দ্রনাথ প্রযোজক, ছবি পরিচালনা করবেন 'কল্লোল' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। দেবকীকুমারকে দিয়ে গল্প ও চিত্রনাট্য লেখানো হল। কিন্তু, গল্প ও চিত্রনাট্য লিখে দিয়েও সুদর্শন চেহারা নিয়ে রেহাই পেলেন না দেবকীকুমার। তাঁকে দিয়ে নায়ক 'দেববর্মণ'-এর চরিত্রে অভিনয় করিয়ে তবেই ছাড়লেন ধীরেন্দ্রনাথ। 

যাই হোক, ১৯৩০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লেখক ও নায়করূপে রুপোলি পর্দায় দেবকীকুমারের আত্মপ্রকাশ হল যে ছবির মাধ্যমে, তার নাম, 'কামনার আগুন' বা 'ফ্লেমস অব ফ্লেশ'। ছবিটি খুব নাম করল, তিনটে শোয়ে পার্ল সিনেমায় রমরম করে চলল। ধীরেন্দ্রনাথের পরের ছবি 'পঞ্চশর'-এ দেবকীকুমারের আরও নাম হল। দর্শক ও চলচ্চিত্রমহল এক নতুন প্রতিভা ও প্রভূত সম্ভাবনাময় এক উত্তরসূরির সন্ধান পেল। না, এই ছবিতে দেবকীকুমার অভিনয় করেননি। চিত্রনাট্য লিখলেন। আর সেইসঙ্গে অলংকৃত করলেন পরিচালকের আসন। আসনটি যেন এতকাল তাঁরই অপেক্ষায় ছিল। এবার শুরু হল আসনের প্রত্যাশাপূরণের পালা। এত করেও ধীরেন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখলেন না। আকাশ দিলেন, উড়তে দিলেন। নিজে শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, দেবকীকুমারের বেলায় দিলেন সেই বিশ্বাসের মর্যাদা।

বাংলা-হিন্দিতে বিভিন্ন সিনেমা কোম্পানির হয়ে দেবকীকুমার বসু রচনা ও পরিচালনা করতে লাগলেন একের পর এক কালজয়ী চলচ্চিত্র। নিজেও নির্মাতা হয়ে নির্মাণ করতে লাগলেন ছায়াছবি। সেইসব চলচ্চিত্রে স্বাক্ষরিত হতে লাগল তাঁর অসামান্য প্রতিভা। 'অপরাধী', 'চণ্ডীদাস', 'পুরাণ ভকত', 'মীরাবাঈ', 'সীতা', 'বিদ্যাপতি', 'সাপুড়ে', 'কবি', 'রত্নদীপ', 'চিরকুমার সভা', 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য', 'অর্ঘ্য' প্রভৃতি ছায়াছবি সেই সরণিতে চিরস্মরণীয়। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান অনেক। তাঁর পরিচালিত ছবি 'চণ্ডীদাস' (১৯৩২)-এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় সিনেমায় প্রথম প্রবর্তিত হল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা আবহসঙ্গীতের রীতি। তাঁর 'সীতা' ১৯৩৫ সালে ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অর্জন করে নিল 'সার্টিফিকেট অব মেরিট'। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথমবার অর্জিত হল বিদেশি সম্মান। তাছাড়া, ছবিতে থিয়েটারধর্মী অভিনয়ের পরিবর্তে বাস্তবধর্মী অভিনয়রীতি আজ যা আমরা দেখতে পাই, তারও প্রস্তাবনা ও পরিমার্জনা হয়েছে তাঁরই হাতে, তাঁরই ছবিতে। তাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে তো বটেই, এমনকি সংবেদী দর্শকমননে দেবকীকুমার বসু স্রষ্টা হিসেবে শ্রদ্ধেয় হয়ে ছিলেন, শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন, শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন। আর জানিয়ে যাবেন 'এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম' কথাটা মফস্বলের কোন নিষ্ঠাবান প্রতিভার জন্য রূপকথা নয়, কিংবদন্তির গালগল্প নয়; চেষ্টা ও যোগাযোগে হয়ে উঠতে পারে তেমনই এক স্বপ্ন, যে-স্বপ্ন কোন একদিন নিশ্চিত পূরণ হয়...


তথ্যঋণ : 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...