মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যাকে আমরা "বলিউড" বলতেই অভ্যস্ত সেই হিন্দি চলচ্চিত্র সাম্রাজ্যে ষাট এবং সত্তরের দশকে দাপিয়ে কাজ করেছিলেন কয়েকজন বাঙালি পরিচালক। তাঁদের বলা হতো "মিডল অফ দ্য রোড" ডিরেকটর। সেই সময় হিন্দি ছবির যে মূলধারা সেই ঘরানায় তৈরি হতো চূড়ান্ত মেলোড্রামাটিক মোটা দাগের পারিবারিক ছবি অথবা গরীব-বড়লোকের লড়াই, আদর্শের সংঘাত, রাজনৈতিক সংঘর্ষ , মারামারি, চড়া দাগের কমেডি, প্রেম, নাচগান এইসব নিয়ে এক একটা চূড়ান্ত অবাস্তব কাহিনীর চলচ্চিত্রায়ন। অমিতাভ বচ্চন তখন অ্যাংরি ইয়ংম্যান ইমেজ তৈরি করে ফেলেছেন। রাজেশ খান্না তো রোমান্টিক ভাল মানুষ হিরো।
মিঠুন চক্রবর্তী এসে পড়েছেন হিন্দি ছবির জগতে। আর অন্যদিকে গোবিন্দ নিহালনী, মৃণাল সেনদের মতো পরিচালকেরা আর্ট ফিল্ম বা বাস্তবধর্মী ছবি তৈরি করছেন। এই সময়ে কয়েকজন বাঙালি পরিচালক মধ্যবিত্ত মানুষের ছোট ছোট ইচ্ছে, আশা, চাওয়া পাওয়া, হাসি কান্না, সুখ দুঃখ এবং সবথেকে মিষ্টি সুন্দর অনুভূতি... অর্থাৎ প্রেম নিয়ে অপূর্ব কিছু ছবি তৈরির কাজে হাত লাগালেন। এই সিনেমাগুলোর নাম দেওয়া হলো "মিডল অফ দ্য রোড" মুভি। এই ঘরানার ছবির একজন প্রধান কারিগর ছিলেন বাসু চ্যাটার্জি।
বাঙালি হলেও তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজস্থানের আজমের শহরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন অল্প কিছুদিন। বাঙালি জীবনের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ তৈরি হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। ভক্ত ছিলেন শরৎচন্দ্র, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের। মনোজ বসু, সমরেশ বসু, সুবোধ ঘোষ, বিমল কর ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। যখন জীবিকার তাগিদে বম্বে গেলেন, নতুন বাংলা উপন্যাস বেরোলেই অর্ডার দিয়ে বম্বেতে আনিয়ে পড়ে ফেলতেন।
কেরিয়ারের প্রথম পর্যায়ে তিনি ইলাস্ট্রেটর এবং কার্টুনিস্ট হিসেবে ব্লিৎজ ম্যাগাজিনে কাজ করেছেন। সিনেমাতে হাতে খড়ি কলকাতা থেকে বম্বে পাড়ি দেওয়া বাসু ভট্টাচার্যের হাত ধরে। বাসু ভট্টাচার্য ছিলেন কিংবদন্তি বিমল রায়ের ইউনিটের সহকারী। ১৯৬৬–তে তিনি যখন ‘তিসরি কসম’ তৈরি করছেন, তখন বাসু চ্যাটার্জি তাঁর ইউনিটে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
নিজে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করলেন ১৯৬৯-এ – ‘সারা আকাশ’। ছবির কেন্দ্রে এক যুবক। তার রুচি, বিবাহ সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা, তার অস্থিরতা — সব মিলিয়ে এক অন্য ধাঁচের ছবি যা আমূল নাড়া দিয়েছিল দর্শককে। পরের ছবি তিন বছর পরে। ছবির নাম ‘পিয়া কা ঘর’, যে ছবি আরেক বাঙালি নায়িকা জয়া ভাদুড়িকে ‘পাশের–বাড়ির–বউ’ ইমেজটা এনে দিয়েছিল।
বিয়ের পরে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে এক নববিবাহিত দম্পতির নিজস্ব ঘর পাওয়ার সমস্যা। এমন একটি সিরিয়াস ইস্যুকে রোমান্স আর মজার মোড়কে মুড়ে কেমনভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করা যায়, দেখালেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। জন্ম হলো তাঁর নিজস্ব ঘরানার।
কেমন ছিল সেই ঘরানা? তাঁর চূড়ান্ত সফল সবকটি ছবিই সাহিত্য নির্ভর রোমান্টিক ছবি। অমল পালেকর নামের এক নতুন অভিনেতা তখন বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন। তাকে নায়ক করে বাসু বাবু বানিয়ে ফেললেন একের পর এক মজাদার অথচ রোমান্টিক ছবি। আর সেই রোমান্স আসত ডেলি প্যাসেঞ্জারির ট্রেনের কামরায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অফিসে, হঠাৎই কখনো, কখনো বা একটু নাটকীয়ভাবে। আর সেই প্রেমের পথে বাধা হত মূলত আর্থিক অবস্থান।
যদিও তার সমাধানও হতো মজারু পথেই। তাঁর নায়কেরা সাধারণত লাজুক, ভীরু, স্বল্পবাক। নায়িকারাও তথাকথিত বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রীরা নন। ‘সফেদ ঝুট’, ‘মঞ্জিল’, ‘বাতোঁ বাতোঁ মে’, 'চিতচোর,' 'রজনীগন্ধা', ‘দিল্লাগি’, ‘ছোটি সি বাত’ 'খট্টা মিঠা' - এই ধরনেরই ।
হলিউডের বিলি ওয়াইল্ডারের ভক্ত ছিলেন। ফলে প্রথম ছবিতে ইচ্ছে মতো গল্প ভাঙলেও পরে ফিরে এসেছিলেন নিটোল গল্প বলার ঢংয়ে। আর সেসব গল্পের অধিকাংশই ছিল বাঙালি লেখকদের লেখা। সঙ্গে মন ভালো করে দেওয়া গান। এইসব ‘স্নিগ্ধ’ মেজাজের ছবি চূড়ান্ত ভাবে বানিজ্য সফল হয়েছিল কিন্তু। দর্শকের কাছে পৌঁছতে সময় তাঁর লাগেনি বেশি। মজার কথা, যখন অমিতাভ-মিঠুনরা এসেছেন বাসুবাবুর পরিচালনায় ‘মঞ্জিল’ বা ‘শৌকিন’-এর মতো ছবি করতে, তাঁরা তাঁদের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ ছেড়েই এসেছেন। সেই ছবিগুলিও দর্শক পরম সমাদরে গ্ৰহন করেছেন।
শুধু মজার ছবি নয়, সিরিয়াস ছবিতেও বাসুবাবু নিজের দক্ষতা বুঝিয়েছেন ‘স্বামী’ বা ‘রত্নদ্বীপ’ বা ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’র মতো ছবিতে। ছোট পর্দাতেও সমান সফল। ‘রজনী’ বা ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ তো টিভি সিরিয়ালের ইতিহাসে মাইলফলক। এছাড়া, 'হঠাত্ বৃষ্টি', 'টক ঝাল মিষ্টি', 'ত্রিশঙ্কু'-র মত বেশ কিছু বাংলা ছবিও পরিচালনা করেছেন বাসু চট্টোপাধ্যায়।
চলচ্চিত্র জগতে ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় এবং বাসু ভট্টাচার্য যে ধারা তৈরি করেছিলেন তার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পরিচালিত বহু ছবি আজও দর্শকদের মনে অমলিন হয়ে রয়েছে।