বাংলা সঙ্গীতের মুক্তি ও সাধক দিলীপকুমার রায়

নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে শ্রদ্ধা করতেন সকলেই। স্বয়ং গিরিশ ঘোষ রানা প্রতাপ সিংহকে নিয়ে নাটক লিখতে শুরু করেও কলম ত্যাগ করেছিলেন; কেননা, তিনি শুনেছিলেন যে, ওই একই সময়ে প্রতাপ সিংহের জীবন অবলম্বনে নাটক লিখছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। নাট্যরচয়িতা হিসেবে এমনই ছিল তাঁর শ্রদ্ধার আসন। দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায় পিতার সেই নাট্য প্রতিভার উত্তরসূরি হননি, হতেও চাননি।

তবে দিলীপকুমার পিতার প্রতিভার আর-একটি দিকের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন, সেটি হল সঙ্গীত। আসলে, তাঁদের বংশের ধারাতেই প্রবলভাবে মিশে ছিল সঙ্গীতের স্রোত। কারণ, তাঁর পিতামহ দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ মানুষ।

বংশের এই ধারা বেয়েই খুব ছোটবেলাতেই সঙ্গীতে দিলীপকুমারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহ জুগিয়েছিলেন বাবা। আসলে, ছোট থেকেই দিলীপকুমার বাবার কণ্ঠে গান শুনে বড় হয়েছেন। তাছাড়া সপরিবারে তিনি বাবার প্রতিটি নাটক প্রথম শো তো দেখতেনই, তারপরেও দেখতেন একাধিকবার।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন দিলীপকুমারের বয়স মাত্র বছর পাঁচ। বাবা জানতেন যে, সেই বয়সেই নাটকের গানগুলো তিনি দারুণ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাই নাটক শেষে বাড়ি আসার পর বাবা পরীক্ষা করে দেখতেন ক'টা গানের কথা ও সুর দিলীপকুমারের মনে আছে। দেখা যেত, প্রায় প্রতিটি গানেরই প্রথম দুই পংক্তির কথা সঠিক সুরসহযোগে দিলীপকুমার শুনিয়ে দিতে পারতেন। আসলে, এটা ঠিক পরীক্ষা না, বাপ-ছেলের একটা বেশ মধুর খেলা ছিল বলা যায়। এরই ফলে পরবর্তীকালে তিনি সেকেলে আর-পাঁচটি ভদ্রজনের মতো নাটকের গানের প্রতি উন্নাসিক হয়ে ওঠেননি, তাকেও তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে যেতে পেরেছিলেন।

 

DilipKumarRoy1

 

সঙ্গীতের সান্নিধ্য তিনি আজীবন পেলেও বাবা-মার সান্নিধ্য হারিয়েছিলেন অকালেই। মা মারা গিয়েছিলেন তাঁর ছ'বছর বয়সে, আর বাবা মারা গিয়েছিলেন ষোলোয়। আশ্রিত হয়েছিলেন মাতামহের। তা সত্ত্বেও সে-সময় সঙ্গীত তাঁর জীবন থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞদের একজন বিষ্ণুচরণ ভাতখন্ডেজিকে গুরুপদে বরণ করে তাঁর কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। তাছাড়া স্বনামধন্য নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসীর কাছেও নাড়া বেঁধে শিখে নিয়েছিলেন বাংলার অতুল্য সম্পদ কীর্তন গান, অবগাহন করেছিলেন পদাবলির ধারায়, মাতোয়ারা হয়েছিলেন বৈষ্ণবীয় ভাবে। মজলিশ-মাহফিলের সঙ্গীতসুধাকে আত্তিকরণ করতে ছুটে গিয়েছিলেন বাইজিদের কাছে। এভাবেই সঙ্গীতের এক-একটি ধারায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন এই সঙ্গীতরসিক।

সঙ্গীত ও সাহিত্যরসিকের জীবনে প্রায়শই দেখা যায় যে, গণিতের সঙ্গে তাঁদের আড়ির সম্পর্ক। কিন্তু দিলীপকুমার এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে বিএ পাশ করে এই বিষয়ে উচ্চতর পাঠের জন্য তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানকার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যে শুধু সম্মান লাভ করে ফিরেছিলেন তাই-ই নয়; অর্জন করে নিয়ে এসেছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অতুল সম্পদও।

দেশে ফিরে সেই অতুল সম্পদকে বাংলা গানের ধারার সঙ্গে যুক্ত করতে তিনি বদ্ধ পরিকর হয়েছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজস্ব এক গায়নরীতি। তাঁর কণ্ঠে সেই গায়নরীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ফসলগুলির মধ্যে অন্যতম হল তাঁর 'বৃন্দাবনের লীলা অবিরাম' গানটি। পরবর্তীকালে তাঁর এই গায়নরীতিকে 'দৈলীপি ঢং' আখ্যা দিয়েছেন রসিকজন।

নিজে সুরকার হয়েও অন্যের গান গাইবার সময় স্বরলিপির কড়াকড়ি একেবারেই মানতে চাইতেন না দিলীপ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, "কোনো গানকে প্রাণে মূর্ত করে তুলতে হলে তাকে নিজের সৌন্দর্য অনুভূতি অনুসারে একটু আধটু বদলে নিতেই হয়।" দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান গাইবার সময়ও তিনি এর অন্যথা করেননি। যদিও রবীন্দ্রনাথের সুর তাঁর তেমন ভালো লাগত না; তবু কথার মোহের জন্য গাইতে চাইতেন। কিন্তু স্বরলিপির কড়াকড়ির জন্যই কোন আসরে ইচ্ছে থাকলেও তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন না। তবে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সুরের স্বাধীনতা না-পেলেও, তিনি তাঁর প্রিয় নজরুলের কাছ থেকে কিন্তু স্বাধীনতা আদায় করে ছেড়েছিলেন। এ-প্রসঙ্গে 'উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন

 

DilipKumarRoy2

 

"কাজিকে একদিন বলেছিলাম ঠাট্টা ক'রে যদি সে আমাকে না দেয় সুরবিহারের স্বাধীনতা তাহ'লে সভাসমিতিতে যেমন রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বন্ধ করেছি তেমনি তার গান গাওয়াও বন্ধ ক'রে দেব। তাতে উদার সঙ্গীতজ্ঞ মানুষটি আমাকে জড়িয়ে ধ'রে বলেছিল তার প্রাণখোলা হাসি হেসে: "আমি যে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত তা কতবার বলব দিলীপবাবু! আমার গান আমারই মেয়ে বটে, কিন্তু আপনি যখন গাইছেন তখন আপনি যে বাপকেও ছাড়িয়ে হলেন জামাই।"

যাই হোক, দিলীপকুমার ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য গান গাইতে শুরু করেন। এক রেকর্ডে দুটি গান। প্রথম রেকর্ডের একপিঠে ছিল 'রাঙ্গা জবা কে দিল তোর পায়ে' গানটি, অপর পিঠে ছিল 'ছিল বসি যে কুসুমকাননে'। গান দুটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার শ্রোতাকুল পেয়েছিলেন টপ্পা-কীর্তন নিয়ে অভূতপূর্ব নিরীক্ষার স্বাদ। সাড়া পড়েছিল বিদগ্ধ মহলে। এই নিরীক্ষার পথ ধরেই ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর শতাধিক গান। অকৃতদার এই মানুষটি ঋষি অরবিন্দের শিষ্যত্ব নিয়ে পন্ডিচেরি আশ্রমবাসী হওয়ার পর অবশ্য আমৃত্যু শুধুমাত্র ভক্তিগীতির মধ্যেই নিজের আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। এই পর্বের রেকর্ডগুলিতে তাই এই ধারার গানই পরিবেশিত হয়েছে।

দিলীপকুমার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাট্যসাহিত্যে প্রবেশ করেননি ঠিকই; কিন্তু কবিতা ও উপন্যাস রচনায় একদা রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের প্রশংসাধন্য হয়েছিলেন। কিন্তু সে-সব কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে আজ, হারায়নি শুধু বাংলা সঙ্গীতের ধারায় তাঁর অবদান। বাংলা গানে সুরের কঠিন নিরীক্ষা ও অভূতপূর্ব গায়কীর জন্য তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন প্রতিটি সঙ্গীতরসিক বাঙালির কাছে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...