দিব্যেন্দু পালিতঃ কথাকারের পূর্বকথা

পাঠক থেকে সাহিত্যিক। এটা যদি হয়ে ওঠার পথ হয়, তাহলে এই পথেই সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন ভাগলপুরের দুর্গাচরণ হাইস্কুলের ছাত্র দিব্যেন্দু পালিত। এখন কথা হচ্ছে, এই ‘পথ’টি দিব্যেন্দু পেলেন কোথায়?

আসলে, তিনি নিবিষ্ট পাঠক হয়ে উঠেছিলেন মায়ের জন্যই। কারণ, মা ছিলেন যাকে বলে একেবারে ‘বইপোকা’, তাই। ভাগলপুরের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর পাঠাগার থেকে মায়ের জন্য রাশি রাশি বই আসত। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সেই আমলের আধুনিক লেখক প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-বনফুলদের রচনাসম্ভার। মায়ের দেখাদেখি সাহিত্যপাঠের অভ্যেস তৈরি হয়ে গেল দিব্যেন্দুরও। সাহিত্য পাঠেরক্ষেত্রে বড়দের বা ছোটদের বলে কোন বাছবিচার তাঁর ছিল না। বইপড়াটা তাঁর এমন নেশায় দাঁড়াল যে, মায়ের আনা বই পড়া হয়ে গেলেই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে এন্তার বই এনে তাও শেষ করে ফেলতে লাগলেন তিনি।

বাংলার পাশাপাশি স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের নির্দেশে ইংরেজি ক্লাসিকের পাঠও চলতে লাগল। আর এই পাঠ চলতে চলতেই একদিন তাঁর মনে হল, চাইলে এমন লেখা তো তিনিও লিখতে পারেন! অন্তত চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই। সাহিত্য থেকে সাহিত্যের এবং পাঠক থেকে সাহিত্যিক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেলেন তিনি। সাহিত্যের প্রতি গড়ে ওঠা আমূল ভালোবাসায় সেই অনুপ্রেরণাকে লালন করতে লাগলেন। তারই ফসল গল্প-কবিতারা প্রকাশিত হতে লাগল স্কুলের হাতেলেখা দেওয়াল পত্রিকায়। সেই সঙ্গে ডাকযোগে চলতে লাগল সুদূর কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকাগুলোয় আত্মপ্রকাশের অদম্য প্রচেষ্টা। সেটা অমনোনীত লেখা ফেরত আসার যুগ। কাজেই লেখারা প্রেরকের ঠিকানায় ফেরত এসে নিয়মিত জানিয়ে যেতে লাগল যে, তারা বাতিল হয়েছে কোথাও। কিন্তু, সেই বাতিলবার্তা দিব্যেন্দুকে দমাতে পারল না কোনদিন।

তখন সবে মেট্রিক পাশ করে কলেজে ঢুকেছেন। বছর ষোল বয়স। ভাগলপুরের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অন্যান্য বছরের মতোই আয়োজন করল, সর্বভারতীয় সাহিত্য প্রতিযোগিতার। এবার ভাবলেন প্রতিযোগিতায় গল্প দেবেন। কিন্তু খানিক দ্বিধাও হল। একবার ভাবলেন, না থাক। আবার ভাবলেন, কী আর হবে, পত্রিকাদপ্তরের মতো এখানেও নিশ্চয় তাঁর গল্প বাতিল হবে! হোক গে, তবু বিচারকমণ্ডলীর বিশিষ্ট ক’জন লেখক তো সে লেখা পড়বেন। কষ্টিপাথরে নিজের লেখা যাচাইয়ের এ-যেন এক মস্ত সুযোগ। সেই সুযোগ নিতে তাঁর ভারি ইচ্ছে হল। তাই প্রতিযোগিতার গল্প-বিভাগে চুপচাপ একখানা গল্প পাঠিয়েই দিলেন দিব্যেন্দু। বাতিল হলেই পাছে লোক হাসাহাসি করে, তাই কাউকে কিছু বললেন না।

আগ্রহ এবং আশঙ্কার মাঝেই ক’টা দিন কেটে গেল। এল প্রতিযোগিতার ফলাফল জানার দিন। দেখা গেল, এবারের বাতিল-আশঙ্কা তাঁর সত্যি হল না। তাঁর গল্পটিই পেল প্রথম পুরস্কার। শুধু তাই নয়, বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি সাহিত্যিক বনফুল স্বয়ং তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর লেখার হাত ভালো। চালিয়ে যা!’ অগ্রজের এই আশীর্বাদে উত্তুঙ্গ উৎসাহ যেমন পেলেন দিব্যেন্দু, তেমনি তাঁর জীবন থেকে ‘বাতিল’ নামক দুর্গ্রহও যেন কেটে পড়ল ঝপ করে।

অল্পদিনের মধ্যেই, ১৯৫৫ খিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি তাঁর গল্প ‘ছন্দ-পতন’ প্রকাশিত হল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘রবিবাসরীয়’ ক্রোড়পত্রে। মাত্র ষোল বছর বয়সেই একটি প্রথমসারির বাণিজ্যিক পত্রিকায় তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটল। সতেরো বছর বয়সে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হল। গল্পের নাম, ‘নিয়ম’। কুড়ি বছর বয়সে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস, ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই’ও।

সাহিত্যিক জীবনে তিনি যখন এভাবে পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখনই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ঝাঁপিয়ে পড়ল দুরগ্রহ। বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। সেটা ১৯৫৮ সাল। দাদা-দিদিরা সংসারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অল্পদিনেই হাঁপিয়ে উঠলেন। দিব্যেন্দু বুঝলেন, এবার নিজেরটা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। চাকরি চাই, বাঁচার জন্য একটা অবলম্বন। কিন্তু, অবলম্বন কোথায়? দেশ ভাগ করে পাওয়া স্বাধীনতার ধাক্কায় দেশ জুড়ে, বাংলা জুড়ে শুধু শরণার্থীদের ভিড়। সেই অবস্থায় দিব্যেন্দু ভাগলপুর ছাড়লেন। এলেন কলকাতায়।

কলকাতার আত্মীয়দের বাড়িতে থাকার জায়গা হল না। শেয়ালদা স্টেশন হয়ে উঠল আশ্রয়। পরের গলগ্রহ না-হয়ে, হয়ে উঠলেন ভিড়ের একজন। কিন্তু, শরণার্থীদের একজন তিনি হতে পারলেন না। তাই অবাঞ্ছিতের মতো আশ্রয় জুটলেও, খাবার জুটল না। খাবার কেনার পয়সা জোটাতে ভরসা একমাত্র কলম। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি গল্পের বিনিময়ে অর্জিত সামান্য অর্থে ক’দিনই বা চলে। তাই আহারের মাঝে মাঝে অর্ধাহার আর অনাহারের পালাও চলতে লাগল সমানে। জীবনের এই বিচিত্র বাঁকে এসে যেমন কৃচ্ছ্রসাধনার চুড়ান্ত হল তাঁর; তেমনি দেখলেন বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র জীবন; সাক্ষী রইলেন বিচিত্র ঘটনার; জীবন নিংড়ে পুষ্ট হল তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি; যা সমৃদ্ধ করল তাঁর সাহিত্যকে।

এবার বলি একটি দীর্ঘ অনাহারী দিনের কথা। একদিন স্টেশনে বসে দিব্যেন্দু কাঁদছেন। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়েছেন। তবু পিঠ সামান্য কেঁপে কেঁপে উঠছে। অসুখী মানুষমাত্রেই বুঝবে, তিনি কাঁদছেন। হাতে একটাও পয়সা নেই। ভদ্রলোকের ছেলে, ভিক্ষে করার উপায় নেই। অথচ খিদেও সহ্য করার আর ক্ষমতা নেই। তাঁকে দেখে একটি বুড়ির বোধহয় মায়া হল। মাতৃত্বের মায়া। শরণার্থী শিবিরের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে শালপাতায় সংগ্রহ করা ক’খানা রুটি আর তরকারি নিয়ে এগিয়ে এলেন তাঁর কাছে। বললেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের ছেলে। খাওয়া হয়নি। তুমি এটা খাও বাবা।’

দিব্যেন্দু মানুষের মহত্বের কথা শুনে সাহিত্য করতে আসেননি, এভাবেই তাঁদের দেখলেন জীবনের প্রতি পদে। যেমন, সাহিত্যসূত্রে তাঁর বন্ধু হয়ে ওঠা মানুষজনদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরেই একদা শেয়ালদার নিরাপত্তাহীন আশ্রয় থেকে দক্ষিণ কলকাতার আপাত নিরাপদ শেল্টারে ঠাঁই পেলেন। আবার যখন তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ পাশ করে চাকরি নিলেন নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায়, তখন কাছ থেকে দেখলেন একগোছা নৃশংস মানুষকে। যারা মানুষকে প্রোডাক্ট ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। তাদের কথাও তুলে আনলেন সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যে প্রথম কর্পোরেটজীবনের অলিগলি তুলে ধরার কৃতিত্ব তাঁরই। ‘ঢেউ’, ‘বিনিদ্র’-র মতো উপন্যাস সেই জীবনেরই সফল দর্পণ। ফলে, মানুষের মহত্ব এবং নীচত্ব সবটুকুর পরিপূর্ণ, বাস্তব ও রূঢ় অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল তাঁর সাহিত্য। উজ্জ্বল, কেননা সব অন্ধকারের মাঝে কবির মতো তিনি আলোর সন্ধান করেছেন, পেয়েওছেন।

দিব্যেন্দু পালিত কথাসাহিত্যিক এবং কবিও। তাঁর সাহিত্যে তাই গদ্যের পংক্তিমালার অন্দরে বয়ে যায় কাব্যব্যঞ্জনার চোরা স্রোত। উঠে আসে শব্দের অন্তরের অভিঘাত। তাঁর ‘সহযোদ্ধা’, ‘আমরা’, ‘অনুভব’ প্রভৃতি উপন্যাস বিষয় এবং ফর্মে কালজয়ী। তাঁর সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে কলকাতা মহানগর, মহানগরের মানুষ। তাঁর ব্যক্তিগতজীবনেও। জীবিকার সন্ধান করতে গিয়ে প্রথম যৌবনে তাঁর যে-শহরের কথা মনে এসেছিল, তা হল, কলকাতা। কলকাতা তাঁকে তিতেমিঠে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে। তাঁর নিজস্ব সাহিত্যভাষা নির্মাণের প্রেক্ষাপট দিয়েছে। তাঁর স্বপ্নের সাহিত্যজগতে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই মহানগর তাঁকে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছিল যে, হাজার প্রলোভনেও এ-ভূমি ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে পারেননি। চানওনি। সময়ের হাত ধরে তাঁর নশ্বর দেহ হয়তো এ-মহানগর পেরিয়ে চলে গেছে একদিন; কিন্তু, তাঁর অবিনশ্বর সৃষ্টিরা সময় জাগিয়ে শহর জাগিয়ে সাহিত্যের আঙিনায় বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়ে যাবে বহু বহু কাল...

 

তথ্যঋণঃ দিব্যেন্দু পালিতের সাক্ষাৎকার, অমর মিত্র সম্পাদিত ওয়েব-ম্যাগাজিন ‘Bookপকেট’।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...