বিশ্বের দরবারে ভারতীয় বস্তবাদী দর্শনের প্রথম ব্যাখ্যা দেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন ইংরেজ সরকারের একজন উঁচুদরের আমলা। সেই সঙ্গে ছিলেন ভয়ানক রকমের হিন্দু। ছিলেন অসম্ভব রকমের জাতিগত শুচিবায়ুগ্রস্ত। ইংরেজের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করার পর প্রতিবার গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে তবেই অন্য কিছু স্পর্শ করতেন। এই ব্যাপারটা ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। ইংরেজের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করার পর তিনিও গঙ্গাজলে হাত ডুবিয়ে তারপর অন্যকিছু স্পর্শ করতেন।

যাই হোক, দেবীপ্রসাদের বাবা অর্থাৎ যে আমলা ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম, তাঁর নাম, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়। মজার কথা, তিনি ছোঁয়াচ মানলেও পুত্র দেবীপ্রসাদ কিন্তু জাতপাত মানতেন না, উঁচু-নীচু মানতেন না, ধর্মের বেড়ি মানতেন না। তিনি ছিলেন পাঁড় কমিউনিস্ট। মানবতা ছাড়া আর কারও কাছে নত হতে জানতেন না।

দেবীপ্রসাদ মানবতার দীক্ষা শুধু যে কমিউনিজমের তত্ত্বের আধার থেকে আহরণ করেছেন এমন নয়, পিতার কাছ থেকেও পেয়েছেন। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব! আসলে, প্রিজমে বিশ্লিষ্ট রশ্মির মতো মানবচরিত্রেরও বহুধা বর্ণ থাকে, তাঁর পিতারও ছিল। যে মানুষটা ইংরেজ ছুঁলে হাত ধুতেন গঙ্গাজলে, সেই মানুষটাই কলকাতার বুকে ছেচল্লিশের দাঙ্গায় ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করতে এক মুসলিম ফল বিক্রেতাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বড় হয়ে ওঠার কালে দেবীপ্রসাদ বাবার দুটোদিকই পাশাপাশি দেখেছেন। সংকীর্ণতার দিকটা বর্জন করেছেন। উদারতার দিকটা গ্রহণ করেছেন। ক্রমে আজন্ম তাঁর সেই উদারতার দিকেই আগ্রহ প্রসারিত হয়েছে। তিনি সেই আগ্রহকে প্রশ্রয় দেয়েছেন। বেড়েছে প্রজ্ঞার প্রতি দুর্বলতা।

প্রজ্ঞার পথে যাকে বলে কৃতী বা মেধাবী ছাত্র, দেবীপ্রসাদ ছিলেন তাই-ই। ফলে, কৃতিত্বের সঙ্গেই এগিয়েছে তাঁর প্রথাগত শিক্ষা। ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন পেরিয়ে দর্শন নিয়ে স্নাতক হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এম.এ পাশ করেছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দুটোতেই প্রথম হয়েছেন। দুটোতেই গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। সারা দেশে ক্রমে ছড়িয়েছে পাণ্ডিত্যের খ্যাতি। সিটি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট, বিজ্ঞানে বিদেশি ডিগ্রি, সম্মানপ্রাপ্তি প্রভৃতির সমারোহ একের পর এক চলেইছে তারপর…।

পাণ্ডিত্য দেবীপ্রসাদের অলঙ্কার ছিল। কারণ, পাণ্ডিত্যকে তিনি ব্যারিকেড হতে দেননি। যখন কলম ধরছেন, সহজ ভাষায় বিজ্ঞানকে একেবারে সাধারণের মতো করে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু চেয়েছিলেন বঙ্গে বিজ্ঞানের চর্চা হোক বঙ্গভাষাতেই। দেবীপ্রসাদের হাত ধরে যেন তাঁর সেই স্বপ্নই পূরণ হবার পথ পেয়েছে অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা ‘জানবার কথা’ নামের সিরিজগ্রন্থের মধ্য দিয়ে। তারপর একে একে লিখেছেন, ‘সত্যের সন্ধানে’, ‘সে যুগের মায়েরা বড়’, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’, ‘বিজ্ঞান কী ও কেন’ গ্রন্থমালা। আসলে, সহোদর সাহিত্যিক কামাক্ষীপ্রসাদের সঙ্গে ছোটদের পত্রিকা ‘রঙমশাল’-এর সম্পাদনা করতে গিয়ে ছোটদের মতো করে বিজ্ঞানকে তাদের অন্তরে পৌঁছে দেওয়ার যে তাগিদ তিনি অনুভব করেন; তা থেকেই ঐ সব লিখনমালার জন্ম।  

ক্রমে দেবীপ্রসাদের সহজ লেখনীতে ভারতীয় দর্শনও সাধারণের কাছে পৌঁছবার সুযোগ পেয়েছে। ভাষারূপ পেয়েছে ভারতের ভাববাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের প্রকৃত তাৎপর্য। লিখেছেন ‘ভারতীয় দর্শন’, ‘লোকায়ত দর্শন’, ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গ’, ‘ভাববাদ খণ্ডন’ প্রভৃতি গ্রন্থাবলী। দর্শনের ছাত্র হয়েও বিজ্ঞানে আগ্রহ নিয়েও যৌবনে দেবীপ্রসাদ সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। তাই ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ স্থাপিত হলে, তিনি তাতে যোগ দিয়েছিলেন। আর-পাঁচজন সাহিত্যের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণের মতো তিনিও প্রথম জীবনে কবিতা লিখতেন, কবি হতে চেয়েছিলেন। এ-ব্যাপারে গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন কবি সমর সেনকে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছাপাতে কারও কাছে হাত পাতেননি, কারও দ্বারস্থ হননি। বরং কলেজে পাওয়া সোনার মেডেল বিক্রি করে দিয়েছিলেন। যদিও ঐ প্রথম কাব্যই হয়ে উঠেছিল তাঁর শেষ কাব্য। কেননা এরপরই তাঁর লেখালেখির জগত ভিন্ন দিকে মোড় নেয় কমিউনিস্ট পার্টির সূত্র ধরে। সমর সেনের মাধ্যমেই এই সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেখানে তাঁর পাণ্ডিত্য সমীহ পেতে শুরু করে। পার্টির ‘মার্কসবাদী’ পত্রিকার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। সেই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় তাঁর দর্শনচর্চা। মার্কসের তত্ত্ব আত্মস্থ করা এই ব্যক্তিটি বিজ্ঞানীর নির্মোহ মন নিয়ে দর্শনের বিচার করতে বসেন। তাই আর-পাঁচজনের মতো সেদিন ভারতীয় ঐতিহ্যকে অবজ্ঞার চশমা চোখে দিয়ে তিনি দেখেননি। তাকে বিশ্লেষণ করেছেন। ‘কি/কী’ ও ‘কেন’ কষ্টিপাথরে যাচাই করতে করতে ভাববাদী দর্শনকে উলটেপাল্টে দেখেছেন। তারপর তাকে খণ্ডন করেছেন। দেখেছেন, ভাববাদীদের জীবন বিমুখ দর্শনের ভগ্নস্তূপের ওপর কীভাবে লোকায়ত বা বস্তুবাদী দর্শন গড়ে । তিনিই প্রথম বিশ্বের উঠেছে। বিশ্বের দরবারে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, ভারত কেবল ইশ্বরমূলক ভাববাদী দর্শনের দেশ নয়, পাশাপাশি এখানে নাস্তিক-বস্তবাদী ভাবনাও প্রবলভাবে প্রচলিত ছিল। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। শুধু তাই নয়, ভাববাদী ভাবনা বলে যা প্রচারিত, তার ভেতরেও রয়েছে বস্তবাদী দর্শনের অনুষঙ্গ।

আসলে, দেবীপ্রসাদ আমাদের শিখিয়েছেন পূর্বসিদ্ধান্ত ছেড়ে নির্মোহ মন নিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দর্শনকে উল্টে-পাল্টে দেখতে, তাকে বিশ্লেষণ করতে, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে। তিনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। ভাবনার ধুলো সরিয়েছেন অন্তর হতে। সেই পণ্ডিতকেই আমরা গুরুপদে বরণ করি, যিনি জ্ঞান-অঞ্জন দিয়ে আমাদের অন্তর খুলে দেন। দেবীপ্রসাদ তেমনই এক পণ্ডিত। তিনি আমাদের বোধির প্রসারে সেই গুরুর ভূমিকাই পালন করে গেছেন আজীবন। তাই তিনি আছেন, শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন আমাদের কাছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...