".....বাঙালীর ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয়, তাহা নহে - সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়।
.....দক্ষিণাবাবুকে ধন্য! তিনি ঠাকুরমা'র মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন, তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে; রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন ইহাতে তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ এবং স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছিলেন তাঁর নাম.....দাঁড়ান পাঠকবন্ধু, তাঁর নামটি বলার আগে আপনাদের একটা প্রশ্ন করি, যদিও জানি যে উত্তরটা আপনাদের সকলের জানা। আপনারা প্রত্যেকেই শৈশবে রূপকথার কাহিনী পড়েছেন অথবা শুনেছেন।
বিদেশী রূপকথা বলতেই তেমন "গ্রিম ভাইদের রূপকথা" বা "রুশদেশের উপকথা"-র কথা মনে আসে তেমনি বাংলা রূপকথা বললেই কোন নামটা সবার আগে মনে আসে বলুন তো? আমি জানি সবাই এককথায় উত্তর দেবেন…
"ঠাকুরমার ঝুলি"। আর এই ঠাকুরমার ঝুলির রচয়িতার নাম হল দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকায় তাঁকে "দক্ষিণাবাবু" বলে উল্লেখ করেছেন।
পাঠকবন্ধু, মনে পড়ে "রূপ দেখতে তরাস লাগে বলতে করে ভয়, কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়...?" কেই বা ভুলতে পারে বুদ্ধু ভুতুমকে? অথবা লালকমল নীলকমলকে, যাদের রাক্ষসী রানী গিলে খেয়ে ফেললেও মারতে পারেনি। তারা দুটি ডিমের মধ্যে সুরক্ষিত ছিল। পরে তারা দুই ভাই মিলে সব খোক্কস আর রাক্ষসী রানীকে বধ করেছিল। অথবা সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালার গল্প? সুখু দুখু, শীত বসন্ত, কাঁকনমালা কাঞ্চনমালা... কেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠে চরিত্রগুলি।
রাজা, রানী, রাজপুত্র, রাজকন্যা, সাধারণ মানুষ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-ভুল, ভালবাসা, নীতিবোধের যে জগৎ... একটা শিশুর ছোট থেকে বড় হওয়ার জন্য সেই কল্পনা ও বাস্তব মিশ্রিত মায়া জগৎটায় বিচরণ করাটা খুব দরকার। আর শিশুদের জন্য এই কল্পলোকের মায়া-পৃথিবী সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। বাংলা রূপকথার জনক বলা যেতে পারে তাঁকে।
১৮৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার উলাইল গ্ৰামে এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। বাবা রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার এবং মা কুসুমকুমারী দেবী। শৈশবে তাঁর মায়ের কাছে রূপকথার গল্প শুনে শুনেই সেই কল্পজগতে পদার্পণ তাঁর। কিন্তু কৈশোরেই মাতৃহীন হন তিনি। পিসি তুলে নেন তাঁকে বড় করার দায়িত্ব। মাতৃস্নেহে মানুষ করেছিলেন মাতৃহারা ভ্রাতুষ্পুত্রকে।
প্রথাগত পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কম থাকলেও সাহিত্যচর্চায় অপরিসীম আগ্রহ ছিল। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে "উত্থান" নামে একটি কবিতার বই লিখেছিলেন তিনি। কিশোর বয়সে স্কুল হোস্টেলে একবার লুকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়ার জন্য তিরস্কৃত হতে হয়েছিল তাঁকে।
তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো বাংলা ভাষায় প্রথম রূপকথার বই লেখা। দক্ষিণারঞ্জনকে জমিদারি পরিচালনা করার কাজে গ্ৰামে গ্ৰামে ঘুরতে হতো আর মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে তিনি সংগ্ৰহ করে বেড়াতেন প্রচলিত যত গল্পগাথা, উপকথা, কিংবদন্তী। সেই সব জড়ো করে তিনি সৃষ্টি করলেন প্রথম বাংলা রূপকথার বই, কালজয়ী "ঠাকুরমার ঝুলি"। ১৯০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় "ঠাকুরমার ঝুলি" এবং প্রথম সপ্তাহেই তিন হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। অথচ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শিশু সাহিত্যিকের এই চিরদিনের সেরা বইটি প্রথমে ছাপতেই চাননি প্রকাশকরা। এ আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই নয়।
ঠাকুরমার ঝুলি ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি বই লিখেছিলেন যার মধ্যে ঠানদিদির থলে, ঠাকুরদাদার ঝুলি, চারু ও হারু যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিল। দক্ষিণারঞ্জন যে শুধু অসাধারণ লেখক ছিলেন তাই নয়, তিনি অসামান্য একজন শিল্পীও ছিলেন। নিজের বইয়ের সমস্ত ছবি তাঁর নিজের আঁকা। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় দক্ষিণারঞ্জনের আঁকার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
ছোটদের জন্য যেমন সুন্দর লিখতেন, ছবি আঁকতেন, তেমন ছোটদের খুব ভালবাসতেন তিনি। ১৯৫৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু বাঙালির শৈশব কৈশোরে তিনি চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যাবেন।