চিন্ময় রায় ছাড়া আজও 'টেনিদা' চরিত্রে আর-কাউকে মানায় না

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে চিন্ময় রায় ছিলেন পরিচালক তপন সিনহার আবিষ্কার। সেটা গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তবে অভিনয় জগতে পা রাখার আগে যে সলতে পাকানোর ব্যাপারটা থাকে, চিন্ময় রায়ের জীবনে সেটা শুরু হয়েছিল ছয়ের দশকের শুরুতেই এনতার নাটক ও সিনেমা দেখার মধ্য দিয়ে।

সেই সূত্রেই প্রথম অভিনয় পাড়ার নাটকে। তাতে চিন্ময় এত ভালো অভিনয় করলেন যে, সকলেরই বেশ বাহবা পেলেন। তবে, সেই অভিনয় দেখে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন ঠাকুমা। বাড়ির ছেলেমেয়েরা অভিনয় করবে, এতে পরিবারের প্রবীণেরা মোটেই উৎসাহ দিতেন না। কারণ, তাঁরা এই জগৎটাকে একেবারেই ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু চিন্ময়ের ঠাকুমা এ ব্যাপারে ছিলেন ব্যতিক্রম। মূলত তাঁরই প্রশ্রয় পেয়ে চিন্ময় মন দিলেন অভিনয়ে, যোগ দিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের নাটকের দল 'নান্দীকার'-এ।

ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, রাসবিহারী মোড়ের মুক্তাঙ্গন রঙ্গমঞ্চে রমরম করে চলছে নন্দীকারের নাটক 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী'। সেই নাটকে অভিনয় করে চিন্ময় তখন পেয়ে চলেছেন তখনকার সব দিকপাল অভিনেতাদের প্রশংসা। এর মধ্যেই একদিন সেই নাটক দেখতে এলেন একসঙ্গে তিন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা এবং অভিনেতা নির্মলকুমার। আর এখানেই তিনি চোখে পড়ে গেলেন তপন সিনহার। হিরে চিনে নিতে তাঁর ভুল হয় না। তাই মেঘ না চাইতেই জলের মতো দিন কয়েকের মধ্যেই তাঁর কাছ থেকে ডাক পেলেন চিন্ময়।

 

ChinmoyRoy1

নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তপনবাবু তাই। বিখ্যাত পরিচালক, কিন্তু মাটির মানুষ। একরাশ সম্ভ্রম নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন চিন্ময়। জানতে পারলেন, তপনবাবু 'গল্প হলেও সত্যি' নামের একটি ছবি করছেন। তাতে একাধারে চোর ও চাকরের একটি ছোট্ট রোল আছে।

তপনবাবু এত ভালো স্ক্রিপ্ট পড়তেন যে, শ্রোতার কাছে চরিত্র একেবারে রক্তমাংসের রূপ নিয়ে ধরা দিত। তিনি চিন্ময়কে তাঁর অংশগুলো পড়ে শোনালেন। তারপরেও বিনয়ের সঙ্গে বললেন, 'ভালো লাগলে করতে পারো'

তপনবাবুর ব্যবহারে ও স্ক্রিপ্ট শুনে চিন্ময় এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর আর ভালোলাগালাগি নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ছিল না। একজন নবাগত হয়েও অভিনেতা হিসেবে তিনি যে সম্মান তপনবাবুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন, তার তুলনা ছিল না। এভাবেই অত্যন্ত অযাচিতভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে শুরু হল তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা, 'গল্প হলেও সত্যি' ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।

তপন সিনহার একটা মস্ত গুণ ছিল, তিনি কাউকেই টাইপ চরিত্রে বেঁধে দিতেন না। তাই চিন্ময় রায় প্রচুর বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তপনবাবুর ছবিতে। প্রথম ছবি থেকেই তাঁর প্রিয় অভিনেতাদের একজন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন চিন্ময়। তাই একের পর এক ছবিতে কাস্ট করেছেন তাঁকে।

তপনবাবু আর একটা জিনিস তাঁর ছবিতে খুব সাফল্যের সঙ্গে করতেন, সেটা হল, গায়ক বা না-গায়ক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে চরিত্রের মেজাজ বুঝে গান গাইয়ে নিতেন। 'গল্প হলেও সত্যি'-তে রবি ঘোষকে দিয়ে 'কা তব কান্তা' গিয়েছেন, পরের ছবি 'হাটেবাজারে'-তে চিন্ময় রায়কে দিয়ে গাওয়ালেন 'আগে আগে ননদী চলে' গানটি। গানটি সে-সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

 

ChinmoyRoy2

তপন সিনহার ছবিতে চিন্ময় রায় চোর, চাকর, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রকবাজ, সংগ্রামী শ্রমিক, হিপি প্রভৃতি নানান ধরণের চরিত্রে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনি সুধীর মুখার্জীর 'ননীগোপালের বিয়ে' ছবিতে বিশুদ্ধ হিরো চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে তিনি অবশ্য কমিক হিরো।

চিন্ময় রায় না-থাকলে যে ছবিটা হত না, সেটা হল, 'চারমূর্তি'। টেনিদা চরিত্রে তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই ভাবা যায়নি। এখনও ভাবা যায় না। কেননা, এখনও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সিরিজ পড়তে গেলেই অবচেতন বেয়ে চেতনে একজনের ছবিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি চিন্ময় রায়। অভিনেতার চেহারার সঙ্গে সাহিত্যিকের কল্পনার এমন আশ্চর্য মিল, খুব কমই দেখা যায়।

বাংলা সিনেমায় কমেডি অভিনেতা হিসেবে চিন্ময় একটা অন্য ধারার সূচনা করেছিলেন। স্ল্যাপস্টিককে হাতিয়ার করেও তাকে নিজের ম্যানারিজমের সঙ্গে তিনি সুন্দরভাবে মিলিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করতেন, যা একইসঙ্গে শিল্পীত ও উপভোগ্য হয়ে উঠত। সেই ধারার ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'ধন্যি মেয়ে', 'বসন্ত বিলাপ', 'ব্রজবুলি' প্রভৃতি।

চিন্ময় রায় না-থাকলে একটা ডায়ালগের জন্মই হত না। যে ডায়লগ এখন প্রায় প্রবাদ, 'একবার বলো উত্তমকুমার!'

মনে আছে পরিচালক দীনেন গুপ্তর 'বসন্ত বিলাপ' ছবির সেই সিনটার কথা, যেখানে পুকুর ঘাটে প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম করছেন প্রেমিক চিন্ময়?

 

ChinmoyRoy3

আসলে সেই অসাধারণ দৃশ্যটির জন্য স্ক্রিপ্টে তেমন কোন ডায়লগ ছিল না। পরিচালক বলেছিলেন ইম্প্রোভাইজ করতে, ব্যস, চিন্ময়কে খুব বেশি ভাবতে হয়নি; মন্ত্রের মতো বেরিয়ে এসেছিল ডায়লগ, 'একবার বলো উত্তমকুমার!'

যে-সময় আপামর বাঙালি মেয়েদের কাছে আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিক পুরুষের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন উত্তমকুমার, সেই সময় উত্তমকুমারের চেহারার ধারেকাছে না-ঘেঁষলেও তাই প্রেমিকরা চাইত তার প্রেমিকা তাকে উত্তমকুমার ভাবুক! এই চাওয়াটিই হাস্যরসের মোড়কে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে চিন্ময়ের স্বকৃত সংলাপে, সেই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে মহানায়কের প্রতি তাঁর অফুরান শ্রদ্ধাও।

চরিত্রটি অন্য কোন অভিনেতা অভিনয় করলে তিনি হয়তো অন্য রোমান্টিক সংলাপ বানাতেন, তাঁর যা মনে আসত; অন্তত আর যাই হোক, এই সংলাপটির জন্ম হত না। সংলাপে একই সঙ্গে রোমান্টিকতা, শ্রদ্ধা ও বিশুদ্ধ হাস্যরসের মেলবন্ধনে কেমন করে একটা যুগকে চিহ্নিত করতে হয়, সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন চিন্ময় রায়। তাই কালের আখরে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল তাঁর সংলাপ, 'একবার বলো উত্তমকুমার!'

রবি ঘোষ, জহর রায়, নবদ্বীপ হালদার, অনুপকুমার, হরিধন মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বনামধন্য চরিত্রাভিনেতা ও কৌতুকঅভিনেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই চিন্ময় রায় দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, মুগ্ধ করেছিলেন; তৈরি করে নিয়েছিলেন স্বকীয় শৈলী। সেখানে চিন্ময় রায়ের তুলনা একমাত্র চিন্ময় রায়-ই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...