ছায়া দেবী: ব্যক্তিত্বময়ী এক অভিনেত্রীর আখ্যান

প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী বলতে যা বোঝায়, তার সব ক'টি গুণাবলীই ছিল ছায়া দেবীর মধ্যে। অবশ্য তার দু'টি সমুজ্জ্বল কারণও ছিল। 

প্রথমত, সেকালের এক দারুন শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। দ্বিতীয়ত, ভাগলপুরের রাজবাড়িতে তাঁর পিসির বাড়ি। জন্মের পর থেকে বালিকাবেলা অব্দি সেখানেই মানুষ। ফলে, মেজাজে একটা রাজকীয় আভিজাত্য তিনি অর্জন করেছিলেন কিছুটা জন্মসূত্রে, কিছুটা পরিবেশ-প্রতিবেশে থেকে।

পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে আর একটি জিনিস তিনি অর্জন করেছিলেন, তা হল, সঙ্গীত। অর্জিত সঙ্গীত স্থান পেয়েছিল মজ্জায়। তাই তাঁকে দিয়ে হিন্দি ও বাংলা-দুই চলচ্চিত্র জগতই গান গাইয়ে নিয়েছে পর্দায়। প্রফুল্ল রায় পরিচালিত হিন্দি ছবি 'মেরা গাঁও'-তে গেয়েছেন, আর গেয়েছেন বাংলায় 'হাল বাংলা', 'রাঙা বউ' ছাড়াও সুশীল মজুমদার পরিচালিত 'অভয়ের বিয়ে' এবং তপন সিংহের 'হারমোনিয়াম'-এ।

মেজাজ আর তানপুরা শ্যুটিং-এ ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। সবার সঙ্গে তাঁর বনত না। কিন্তু, যে তাঁর আদব বুঝত, তাঁর সঙ্গে বনিবনার কোন অভাব হত না। তপন সিংহের 'নির্জন সৈকতে' ছবিতে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে ভারতী দেবী ছায়ার ওই দুই নিত্য ছায়াসঙ্গীর কথা বলেছিলেন এক স্মৃতি আলেখ্যে।

'নির্জন সৈকতে' চার বিধবার গপ্পো। ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, রুমা গুহঠাকুরতা, শর্মিলা ঠাকুর--এই চারজন অভিনয় করবেন চার বিধবার চরিত্রে। লোকেশন যেহেতু পুরী, তাই ইউনিটশুদ্ধ সকলেই হাজির হলেন সেখানে।

ভারতী দেবী এই প্রথম কাজ করছেন ছায়া দেবীর সঙ্গে। বাকিরাও তাই। ভারতী জানেন ছায়া কত বড়মাপের অভিনেত্রী, তাঁর সঙ্গে অভিনয়-এটা ভাবতেই একটু বুক ধড়ফড় করছিল বৈকি। ছায়া যদি একটু সহজ হতেন, তাঁদের বা তাঁর সঙ্গে যদি মিশতেন; তাহলে না-হয় ব্যাপারটা একটু সহজ হত। কিন্তু, ছায়া যে কারও সঙ্গে মেশামেশির ধার ধারছেন না, যখনই সুযোগ পাচ্ছেন তানপুরা নিয়ে নিজের ঘরে গানে-রেওয়াজে আপন মেজাজে থাকছেন।

এখন করণীয় কী? শেষমেশ সহজ হবার জন্য ভারতী গেলেন তাঁর কাছে। ধীরে ধীরে বললেন যে, একটা সিনে ডায়লগ ডেলিভারিটা কেমন করলে ভালো হয় বুঝতে পারছেন না, ছায়াদি যদি একটু দেখিয়ে দেন, তাহলে ভালো হয়।

ছায়া তানপুরা নিয়ে তাঁর দিকে পিছন ফিরে ব্যস্ত ছিলেন। ভারতীর কথা শুনে শাহি মেজাজের রুক্ষ সুরে বললেন যে, দেখানো-টেখানোর জন্য ডিরেক্টার আছেন, তিনি কেন দেখাতে যাবেন!

Chhaya-Debi1

অমন রুক্ষ কথা শুনে ভারতী কেমন যেন দমে গেলেন। এমন ব্যবহার তিনি আশা করেননি। নিজে যেচে এসেছেন, তায় সিনিয়ার, সুতরাং বলার কিছু নেই। কাজেই মুখের ওপর অমন ধ্যাতানি খেয়ে বড় অসহায় বোধ করলেন ভারতী। তিনি ফিরবার উপক্রম করতেই, ছায়া তানপুরা রেখে তাঁর দিকে ফিরলেন। বললেন যে, দুম করে এসেই, অমনি চলে গেলে হয় না।

এবারকার গলার স্বরে অবাক হয়ে ভারতী থামলেন। ছায়ার মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন, এ যেন এক স্নিগ্ধ মূর্তি। পূর্বের রুক্ষতার সঙ্গে এ-মূর্তির কোন মিল নেই। রুক্ষতাটা যেন আবরণ, যেন ছলনা। স্নিগ্ধতাটাই আসল।

হ্যাঁ আসল বৈকি। তাই তো ছায়া ভারতীকে অসহায় হয়ে ব্যথা নিয়ে চলে যেতে দিলেন না, কাছে টানলেন। যেমন করে বড়দিদি, ছোট বোনটিকে কাছে টানে, তেমন করে। তারপর তাঁকে ডায়ালগের ডেলিভারি দেখিয়ে দিলেন। প্রাণখোলা হাসি-আড্ডায় সঙ্গটিকে ভরিয়ে তুললেন। গান শোনালেন। 

সেই আড্ডায় অবিলম্বে চার বিধবা চরিত্রের চার অভিনেত্রীই এসে জুটলেন। সবাই বুঝলেন যে, ছায়া হলেন যেন তালশাঁস সন্দেশ, বাইরে অল্প কঠিন, ভেতর গোলাপ জলের মতো সহজ সুগন্ধিময়। ছায়ার একটি যথেষ্ট ভালো ডাকনাম ছিল, কনক। পিতৃসূত্রের পদবি ছিল, গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম বিশ শতকের গোড়ার দিকে। 

তা, সে-সময় মেয়েদের পড়াশুনো শেখানোর রেওয়াজ বেশ রমরমিয়ে চলছিল অভিজাত পরিবারগুলোতে। ফলে, ছায়াও বঞ্চিত হলেন না সে সুযোগ থেকে।সে না-হয় হল। কিন্তু, বাড়ির একটি বাজে নিয়ম তছনছ করে দিল ছায়ার জীবন। সে নিয়ম হচ্ছে, বাল্যবিবাহ দেওয়ার নিয়ম। 

নিয়ম মেনে মাত্র এগার বছর বয়সে রাঁচির অধ্যাপক ভূদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। বিয়ে তো দেওয়া হল, কিন্তু সংসারী করা গেল না। জানা গেল, ভূদেবের নাকি সংসারে মন নেই!

বাড়ির নিয়ম, তাই হয়তো একটু একটু করে ছায়ার মনকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে শেখানো হয়েছিল। পতিকে পরম গুরু ভাবতে শেখানো হয়েছিল। নিয়ম মেনেই। তাই ভূদেব যখন বিয়ে করেও সংসার করতে চাইলেন না, তখন নিশ্চিত ছায়া মারাত্মক এক ধাক্কা খেলেন। 

তিনি আধুনিক শিক্ষা যতই পান-না-কেন, স্বামী-সংসার নিয়ে তাঁর মনটিকে সেকেলে করেই গড়া হয়েছিল। নইলে যে মানুষটা কোন অপরাধ ছাড়াই তাঁকে স্ত্রী বলে মেনে নিল না, তাকে ভুলে অন্য কারও সঙ্গে কোনদিন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখলেন না কেন? তাই বলছি যে, ধাক্কাটা বুকের ভেতরে গিয়েই লেগেছিল।

তবে মনটাকে সামলে নেবার উপায়ও তাঁর ছিল। ভাগলপুরে মোক্ষদা গার্লস-এ পড়ছিলেন, ভাগলপুর ছেড়ে বাবার বদলির চাকরির জন্য দিল্লি গেলেন, সেখানেও গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। ফলে, পড়াশুনার মধ্যেই রইলেন। তাছাড়া সুসঙ্গী গান তো ছিলই।

বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় আসতেই কৃষ্ণচন্দ্র দে'র ছাত্রী হয়ে জোরকদমে গান শিখতে লাগলেন। সেই সময় ফের সান্নিধ্য পেলেন দুই পিসতুতো দাদার। শ্রীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শৈলেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা তখন দু'জনেই কলকাতায় থেকে থিয়েটার নিয়ে যৎপরনাস্তি মেতে রয়েছেন।

এতদিন পর বোনকে কাছে পেয়ে দু'জনেই বুঝলেন যে, স্বামী-সংসারের ব্যথাটা ছায়ার মনে একটা শূন্যতার সৃষ্টি করে রেখেছে। সেটা ভরাট করতে হবে। তাকে আরও ব্যস্ত করতে হবে।

শ্রীশচন্দ্রের বজম-বন্ধু উপেন গোস্বামী। তিনি আবার ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার। তাঁর কাছে শ্রীশ জানতে পারলেন যে, পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায় 'পথের শেষে' বলে একটা ছবি করছেন। 

ব্যস, তাঁর মাথায় অমনি খেলে গেল যে, ছায়াকে সিনেমায় আনতে হবে। নাম হলে, যশ এলে, খ্যাতি পেলে ছায়ার ব্যথায় প্রলেপ পড়বে। উপেনকে বলতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। সেটা ১৯৩৫ সালের শেষ দিকের কথা।১৯৩৬ সালের ১৪ মার্চ 'শ্রী' সিনেমায় মুক্তি পেল 'পথের শেষে'। 'পথের শেষে' থেকেই পথ খুলে গেল। 

তখনকার তাবড় পরিচালকদের একজন দেবকী বসু, তাঁর খুব ভালো লাগল এই ছবিতে ছায়ার অভিনয়। অমনি তিনি তাঁর ছবি 'সোনার সংসার'-এ ছায়াকে নিয়ে নিলেন। ১৯৩৬-এ এ-ছবিও মুক্তি পেল। এতে অভিনেত্রী হিসেবে ছায়ার খুব সুনাম হল। শুধু সুনামই নয়, 'সোনার সংসার' করে সোনার মেডেলও পেলেন তিনি।

তারপর একে একে 'রজনী', 'প্রভাস মিলন', 'খনা', 'প্রতিশোধ', 'রিক্তা', 'বিদ্যাপতি'-তে তাঁর সেই সুনাম খ্যাতি ও যশের চুড়ো ছুঁয়ে ফেলল। আর তারই মাঝে হঠাৎ ছায়াছবির জগৎ ছেড়ে ছায়া ফের ভাগলপুরে পাড়ি দিলেন। এমন রাজ্ঞী-জনোচিত সিদ্ধান্ত তাঁকেই মানায়।

ভাগলপুর। তাঁর বাল্যের খেলাভূমি। স্বপ্নের উঠোন। সেখানে গিয়ে তাঁর প্রথম ভালোবাসা সঙ্গীত নিয়েই মগ্ন হলেন। দামোদর মিশ্রের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে লাগলেন। শঙ্কু মহারাজের ছাত্রীর কাছ থেকে নাচ শিখতে লাগলেন। রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করলেন।

ছায়া দেবী ছায়াছবির জগৎটিকে ত্যাগ করলেন বটে; কিন্তু, ছায়াছবির জগৎ তাঁকে ত্যাগ করল না। তাই পরিচালক সুশীল মজুমদারের ঐকান্তিক অনুরোধে তাঁকে আবার অভিনয় জগতে ফেরার কথা ভাবতে হল। 

অনেক টালবাহানার পর শেষমেশ ফিরলেন। অভিনয় করলেন 'অভয়ের বিয়ে' ছবিতে। তারপর একে একে 'দাদা ঠাকুর', 'রাজা রামমোহন', 'আরোগ্য নিকেতন', 'আপনজন' প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করলেন। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হলেন। নায়িকা বলুন, মা বলুন, স্ত্রী বলুন, অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রাভিনেত্রী বলুন-দৃঢ়, দুর্বল, অসহায়, খল যে-কোন চরিত্রকেই তিনি পৌঁছে দিতে লাগলেন সিদ্ধি ও স্মরণের অন্য এক স্তরে। তাই বাংলা সিনেমার ইতিহাসের কতশত রথী-মহারথীদের ভিড়ে ছায়া দেবী তাঁর নিজস্বতার নিরিখে নিরবধি অনন্যা, অসমান্যা এবং স্মরণীয়া হয়ে রয়ে গেলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...