হাওড়া আর হিমালয়। দূরত্ব কতটা?
এক দমকে বলা যায় না। সময় লাগে। হিসেব করতে হয়।
তবু ঘিঞ্জি হাওড়ার তস্য ঘিঞ্জি অঞ্চল কোনায় বসেই স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটা হিমালয় ছোঁয়ার।
স্বপ্ন ছোঁয়া তো দূর এমন স্বপ্ন দেখাও খুব সহজ নয়। তবু পাহাড় বেড়াতে গিয়েই যেন তাকে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নটাকে বুকে আঁকড়ে ঘরে ফিরেছিল অষ্টাদশী ছন্দা। ছন্দা গায়েন।
বাবার স্বপ্ন আর মায়ের আদর এই দুই এক হয়ে গিয়েছিল তার স্বপ্নে। পাহাড় ছোঁয়ার ইচ্ছে মিশে গিয়েছিল রক্তে।
মা ছিলেন শখের ট্রেকার। ভালবাসতেন ট্রেকিং। তাঁর আগ্রহেই মেয়ের পাহাড় চড়ার ক্লাস শুরু। কলকাতার দ্য ইনস্টিটিউট অফ এক্সপ্লোরেশনে।
প্রথমে ছোট ছোট পাহাড়। তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল আয়তন। একদিন পাড়ি পর্বতে।
২০০৬-এ দার্জিলিং-এর হিমালয়ান মাউন্টেনিইয়ারিং ইনস্টিটিউট।
জেদ ছিল সেরা শৃঙ্গ জয়ের। দীর্ঘ তার প্রস্তুতি পর্ব। কঠোর অনুশীলন। এতটুকু ফাঁকি ছিল না সেখানে। কিন্তু বাধার প্রাচীর তুলেছিল আর্থিক সামর্থ্য।
২২ লক্ষ টাকা লাগবে। সরকারী সাহায্য মিলেছে ৫ লক্ষ। কিছুটা ছন্দার নিজের চেষ্টায় স্পনসর। কিন্তু অনেকটাই অধরা।
এবারেও আকাশ হয়ে ছায়া দিয়েছিলেন মা। কিছুতেই হারতে দেখতে পারবেন না যে মেয়েকে! গায়ের সমস্ত গয়না, সঞ্চয়, স্থাবর দিয়ে হল টাকার জোগাড়।
জানতেন না মেয়ে জিতে ফিরবে কিনা, কী অবস্থায় ফিরবে...তিনি শুধু জানতেন মৌন হিমালয় ছুঁতে আত্মজার পাথেয়র দায় তাঁর।
২০১৩ সালের ২৮ মার্চ এভারেস্ট অভিযানে রওনা হলেন ছন্দা। শুরু থেকেই প্রতিকূলতা। রক্ত জমাট বেঁধে যায় এমন ঠান্ডা। তুষার ঝড়ে ওলটপালট আবহাওয়া।
৫৩০০ মিটার উচ্চতায় তৈরি হল বেসক্যাম্প। টানা একমাস সেখানেই আটকে থাকা।
আবহাওয়া একটু ধরন হলে ফের শিখর অভিযান। সঙ্গে তাশি শেরপা। বহু অভিযানে অভিজ্ঞ।
৪৬ মিনিট সময় লেগেছিল। একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট আর মাউন্ট লোৎসে জয় করেছিলেন। শৃঙ্গ জয়ে নতুন রেকর্ড।
বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা গিয়েছিল হাওড়ার মেয়ে ছন্দা গায়েনের নাম। প্রথম বাঙালি মহিলা এভারেস্ট বিজয়নী হিসেবে।
সাড়া পড়েছিল সারা দেশে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাঙালি মেয়েদের অনুপ্রেরণা। বাধা জয়ের তারকা ছন্দা।
সাদাসিধে চেহারা। তারকাজৌলুস কাকে বলে সে মুখ জানে না। ভিড়ে মিশে গেলে আলাদা করা যায় না এই মেয়েকে। শুধু চোখ টেনে নেবে তার চোখ দুটো।
প্রকৃতির মতো সহজ। দীঘির মতো স্বচ্ছ। নিরাসক্ত দৃষ্টি। বিষাদের মায়ায় গভীর। শুধু যেন লক্ষ্যে পৌঁছানোর কথা বলে।
পাহাড় স্বপ্ন ছিল ছন্দার। পর্বতের প্রকৃতি যেন ঘিরে রাখত এ মেয়েকে। ধীর, স্থির, অবিচল। কিন্তু ভিতর ভিতর অভিযানের জন্য আকুল।
এভারেস্টে পৌঁছে আধঘন্টা সেখানে ছিলেন।
চারপাশটা তখন মেঘের দেশ। নিচে টিলার মতো পর্বত শ্রেণী। চোখের সামনে সাদা পথ। দুপাশে বিপদজনক খাদ। বরফ আর বরফ। মাথার ওপর নীল আকাশ।
নিজেকে অনেকটা লম্বা মনে হয় এখান থেকে। দেশের পতাকাটা শীর্ষে রেখে কিছুক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে। অনুভূতিহীন।
এভারেস্ট জয়েই থেমে যায়নি স্বপ্নের গ্রাফটা।
২০১৪ সালে ফের বেরিয়ে পড়লেন। এভারেস্টের অভিজ্ঞতায় টগবগ করছে এনার্জি। এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা। জয় করে ফেরার পথে পশ্চিমে ইয়ানলুঙ কাঙ আরোহনের পরিকল্পনা।
অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ঙ্কর এবারের রুট। কিন্তু ছন্দাও যে অপ্রতিরোধ্য। এক পা ভুল হলেই নিশ্চিত মৃত্যু তবু জেদ অদম্য।
ভয়ানক আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললেন। সঙ্গে দুই শেরপা। প্রবল তুষার ঝড়। রাক্ষুসে খাদ। ধেয়ে এল বরফ ধস। আর রক্ষে নেই...হিমালয়ের কোল টেনে নিল একরোখা দর্পিনি তুষারকন্যাকে।
চিরতরে...
এই জাতি কোনদিন ভুলতে পারবে না তার হারিয়ে যাওয়া পর্বতকন্যাটিকে...
আজকের দিনে উত্তর কলকাতার মানিকতলায় মামাবাড়িতে জন্ম হয় তাঁর।
এভারেস্টজয়ী প্রথম বাঙালিনী।