বাংলা সিনেমার একেবারে আদিপর্বে, গত শতকের প্রথম দশকের শেষদিকে চিত্রপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিতা মেয়েদের ছায়াছবিতে অভিনয় করতে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিজের শিক্ষিতা স্ত্রী ও কন্যাকে চিত্রাভিনয়ের জগতে এনেছিলেন। সেই পথ ধরেই এর কিছুকাল পরে চন্দ্রাবতী দেবী চলচ্চিত্রাভিনয়ে এসেছিলেন।
চন্দ্রাবতীর পুরো নাম, চন্দ্রাবতী সাহু। মজঃফরপুরের এক জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা গদাধরপ্রসাদ সাহু জমিদারি সামলাতেন, সেইসঙ্গে তিনি একজন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে কঙ্কাবতী ও চন্দ্রাবতী। পিঠোপিঠি। গদাধর নিজে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিবান মানুষ। ফলে, মেয়েদের শিক্ষায়-দীক্ষায় তিনি কোন ত্রুটি রাখেননি। মজঃফরপুরে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ হলে তিনি তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠান। কলকাতায় সুকীয়া স্ট্রিটে গদাধরের নিজস্ব একখানা বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে এসে কঙ্কাবতী ও চন্দ্রাবতী দু’জনেই লোকলস্কর চাকরবাকরসহ এসে ওঠেন। ভর্তি হন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। লেখাপড়ার পাশাপাশি দুই বোনই ছোট থেকে গান শিখেছিলেন ওস্তাদ রেখে। কলকাতায় এসে দীনু ঠাকুরের কাছে নাড়া বাঁধেন। শিখতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের গান। গান-নাটক-সিনেমা-শিল্প-সংস্কৃতির শহর কলকাতায় এসে দুই বোনেরই এন্তার নাটক দেখার সুযোগ হয়। সিনেমা দেখার সুযোগ ঘটে। দেখতে দেখতে একদিন অভিনয়ের নেশা ধরে তাঁদের।
কঙ্কাবতী তখন এম.এ পড়ছিলেন। পড়া ছেড়ে তিনি ‘নাট্যমন্দির’ নাট্যমঞ্চে যোগ দিলেন। অনন্য সৌন্দর্য, অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা ও অপূর্ব কণ্ঠসঙ্গীতের সম্পদে অল্পদিনেই বাংলা রঙ্গমঞ্চে স্বনামধন্য হয়ে উঠলেন তিনি। চন্দ্রাবতীও ক্রমে অভিনয়ের আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি ভালোবাসতেন সিনেমা। তবে তিনি আগে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক হলেন, তারপর ছায়াছবির জগতে পাড়ি দিতে চাইলেন। আলাপ হল বিমল পালের সঙ্গে। বিমলবাবু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও অশেষ উদ্যমী পুরুষ ছিলেন। বিভিন্ন রকমের ব্যবসা করতে করতে তিনি এই সময় সিনেমা-থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ঠিক করেন সিনেমা কোম্পানি করবেন। সে-কথা জেনে চন্দ্রাবতী এগিয়ে এলেন এই ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে। তাঁর আর্থিক সহায়তায় বিমলবাবু গড়ে তুললেন সিনেমা সংস্থা, 'মুভি প্রডিউসার্স'।
সেটা নির্বাক সিনেমার যুগ। ম্যাডানদের একচেটিয়া বাণিজ্যের যুগ। তাঁদের টেক্কা দিতে বিমলবাবু চন্দ্রাবতীকে নিয়ে নেমে পড়লেন মাঠে। নিজে পরিচালক হয়ে চন্দ্রাবতীকে নায়িকার ভূমিকায় নামিয়ে ১৯২৯ সালে তৈরি করে ফেললেন 'পিয়ারী' নামের ছবিটি। ছবিটি ব্যাপক সাফল্যের মধ্য দিয়ে চন্দ্রাবতীকে এনে ফেলল একেবারে চিত্রাভিনয়ের মূল স্রোতে। শুধু তাই নয়, এই ছবি চন্দ্রাবতীকে একটি অভিনব গৌরবেরও অধিকারী করল। এই ছবিতে প্রযোজক হিসেবে দেখা গেল তাঁরই নাম। ফলে, তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা ছায়াছবির জগতে প্রথম মহিলা প্রযোজক। তৈরি হল ইতিহাস।
অল্পদিনের মধ্যেই বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শিখল। এল সবাক ছায়াছবির যুগ। তখন তিনি ডাক পেলেন নিউ থিয়েটার্স থেকে। অভিনয় করলেন দেবকী কুমার বসুর 'মীরাবাঈ' ছবিতে। এবার দর্শক তাঁর সুকণ্ঠের গান শুনতে পেলেন। ফলে একদিকে তাঁরা তাঁর অভিনয়ে যেমন মুগ্ধ হলেন, অন্যদিকে তেমনি গান শুনে হলেন অভিভূত। ছবি তো ব্যাপক সাফল্য পেলই, সেই সঙ্গে চন্দ্রাবতীও হয়ে উঠলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। যে যে গুণপনার জন্য চন্দ্রাবতী এই জনপ্রিয়তার সিদ্ধি অর্জন করলেন, সে সম্পর্কে 'এখন যাঁদের দেখছি' গ্রন্থে হেমেন্দ্রকুমার রায় সুন্দরভাবে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,
‘…অভিনেত্রীরা যদি হন একসঙ্গে রূপসুন্দর ও গুণসুন্দর, তাহ’লে বেশী তাড়াতাড়ি তাঁরা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন দর্শকদের হৃদয়ের উপরে। এ শ্রেণীর অভিনেত্রী সুলভ নন। চন্দ্রাবতী হচ্ছেন এই শ্রেণীর অভিনেত্রী।’
গুণময়ী সফল অভিনেত্রী ছিলেন বলেই চন্দ্রাবতী এ-সময়ই জনতার হৃদয়ে চিরকালের আসন তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই সফলতার ধারা বেয়েই তিনি একে একে অভিনয় করলেন 'দক্ষযজ্ঞ', 'দেবদাস', 'দিদি', 'বিজয়া', 'প্রিয়বান্ধবী', 'দুইপুরুষ', 'পথের দাবী', 'শুকতারা' প্রভৃতি ছবিতে। পেলেন অসংখ্য পুরস্কার।
চন্দ্রাবতীর ব্যক্তিত্ব ও অভিনয় সম্পর্কে ‘সবারে আমি নমি’ নামের আত্মকথায় কানন দেবী বলেছেন, ‘তখনকার দিনের মস্ত বড় অভিনেত্রী ছিলেন উমাশশী, চন্দ্রাবতী। নায়িকার খ্যাতিতে পুরোভাগেই এঁদের নাম ছিল।…‘দিদি’ ছবিতে চন্দ্রার প্রেসিডেন্টের অভিনয় এখনও যেন চোখের সামনে ভাসে। ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং ডিগনিফায়েড রোলে ওকে দারুণ মানাত। আর, সব মিলিয়ে ওর জোড়া রূপসীও এ লাইনে খুব কমই ছিল।’
তবু শুধু অভিনয়েই থেমে থাকলেন না চন্দ্রাবতী, সিনেমার প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ছড়িয়ে দিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি বিমলবাবুকে সামনে রেখে নদিয়া জেলায় গড়ে তুললেন প্রথম সিনেমা হল, 'রানাঘাট টকিজ'। এক্ষেত্রেও ইতিহাস তৈরি করলেন তিনি। কেননা, তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি হয়ে উঠলেন একটি সিনেমাহলের মালকিন। আরও একটি ইতিহাস তিনি তৈরি করলেন এ-সময়। 'বায়োস্কোপ' নামের সিনেমা-পত্রিকা প্রকাশ করে। কারণ, তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
গত শতকের তিন ও চারের দশকে চন্দ্রাবতী চুটিয়ে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করলেও পাঁচ ও ছয়ের দশকে চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে আসেন। চরিত্রাভিনেত্রী, কিন্তু অভিনয় প্রতিভায় সেখানেও তিনি হয়ে উঠতেন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয়। এই সময়ের 'জয়জয়ন্তী', 'মরুতীর্থ হিংলাজ', 'আমি সিরাজের বেগম' প্রভৃতি ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখার মতো, শেখার মতো।
চন্দ্রাবতী শুধু যে নিজে ভালো এবং গুণময়ী অভিনেত্রী ছিলেন এমন নয়, অন্যের গুণপনা বিকাশে সাহায্য করার উদারতাও তাঁর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। শোনা যায়, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের গুণপনা চিনে তাঁদের কাছে ছায়াছবির জগতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই।
চন্দ্রাবতী শুধু অভিনেত্রী নন, তিনি একটি বিস্মৃতপ্রায় যুগের ইতিহাস। তাই তাঁকে জানলে, তাঁর অভিনয় উপভোগ করলে সেই বিস্মৃতপ্রায় যুগটিকে জানা যায়, সেই বিশেষ যুগের অভিনয় ঐতিহ্যকে উপভোগ করা যায়; চোখ রাখা যায় ইতিহাসের জীবন্ত পাতায়...
তথ্যঋণ: 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।