কবিতার বুদ্ধদেব ও একটি বৈপ্লবিক কবিতা

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কবিতা তাঁর আদিম ভালোবাসা। অথচ তাঁর মা-বাবা বা নয় ভাইবোনের কেউই কিন্তু কোনদিন কবিতা লেখেননি। তবে এটা সত্য যে, মা কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন। আর মামা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর শক্তিমান কবি। তো, মা'র কাছে কবিতার সান্নিধ্য কিছুটা পেলেও মামার সান্নিধ্য ও সাহচর্যই তাঁকে কবিতা ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।

নিয়মিত মামা তাঁকে সঙ্গে করে বিভিন্ন কবিতা সম্মেলনে ও কবিদের সভায় নিয়ে যেতেন। এতে করে আত্মপ্রকাশের যে দ্বিধা থাকে কৈশোরের, সেই দ্বিধা তিনি সহজেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এবং, সঙ্গগুণে বুঝতে পেরেছিলেন যে, কবিতার ক্ষেত্রে নিজস্বতা চাই ভাষায় ও প্রকাশভঙ্গিতে। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখেছিলেন যে, একই গোষ্ঠীর কবি হওয়া সত্ত্বেও সুনীল, শক্তি, সমরেন্দ্র, শরৎ, উৎপল প্রত্যেকের কবিতার মেজাজ ও মর্জি নিতান্তই আলাদা। এই উপলব্ধির ফলেই বুদ্ধদেবের এই কৈশোর পর্বের কবিতায় অন্যের চেয়ে আলাদা উচ্চারণের সুন্দর একটা প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল।

 

Buddhadeb1

 

বুদ্ধদেবের বয়স তখন সবে তের অথবা চোদ্দ। তাঁর কবিতা সেই প্রথম পত্রিকার পাতায় ছাপার হরফে মূর্তিমান হল। এরপরই 'কৃত্তিবাস''শতভিষা'র মতো পত্রিকাগুলোর নিয়মিত কবি হয়ে উঠলেন তিনি। ষোল-সতের বছর বয়সে 'দেশ' পত্রিকার পাতাতেও জায়গা করে নিলেন। অল্পদিনেই সুব্রত চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, ভাস্কর চক্রবর্তী, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক চক্রবর্তী প্রমুখ উঠতি কবিদের সঙ্গে বন্ধুতাসূত্রে নিজস্ব একটি বলয় গড়ে উঠল। তারপর আঠারো বছর বয়স হতে-না-হতেই প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। 'গভীর এরিয়েলে' (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে)।

বলতে কী, প্রথম থেকেই নিজের ছন্দে এগিয়ে গিয়েছিল বুদ্ধদেবের কবিতার পথ। ঘটেছিল বাঁকবদল। সেও স্বাভাবিকতার ছন্দ বেয়েই। তাই 'গভীর এরিয়েলে' থেকে তাঁর শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'ভুতেরা কোথায় থাকে' ভাবে, ভাষায় ও প্রকাশভঙ্গিতে পরিচিত কলমের ছাপ রেখেও আন্তরিকভাবেই আলাদা। শেষ পর্বে তাঁর বলিষ্ঠ ঝোঁক হয়ে উঠেছিল পরাবাস্তবের পথ বেয়ে জাদুবাস্তবতার ছড়ি দিয়ে দিগন্ত দেখানোর।

 

Buddhadeb2

তবে শুরু থেকে সর্বত্রই বুদ্ধদেব ছিলেন কাব্যলোকের এক নির্মোহ প্রতিবেদক। এমনকি সত্তরের দশকে প্রকাশিত তাঁর 'হিমযুগ' কাব্যগ্রন্থে সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা, তাঁর প্রতিবাদ, তাঁর চেতনা প্রকাশেও সেই নির্মোহ প্রতিবেদকের ভূমিকা থেকে তিনি সরে আসেননি। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, সত্তরের ছাত্র আন্দোলন তাঁকে ভেতরে ভেতরে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল। হত্যা, গুলি, পুলিশি অত্যাচার, রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিকতা সমস্ত কিছুই গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর চেতনায়। তাই নির্মোহ ভাবটিকে বজায় রেখেও নিবিষ্ট ছবিতে তুলে ধরেছিলেন যুগান্তে হারানো বিষণ্ণ সভ্যতার প্রতিবেদন:

"দিনগুলি, যখন বৃষ্টি এবং ঝোড়ো বাতাস এক নাগাড়ে ঠুকরে যাচ্ছে শহর

যখন প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়ি, মানুষ খুঁড়ছে রাস্তা,

রাস্তা খুঁড়ে খুঁড়ে উপড়ে আনছে সুতানুটির রাখাল ছেলের শরীর"

 

Buddhadeb3

 

চরণগুলি যে কবিতার, সেই কবিতাটির নাম, 'চলো যাই'। কোথায় যাবার কথা বলছেন কবি? সত্তরের জ্বলন্ত যুবকেরা গ্রাম দিয়ে নগর ঘেরার যে প্রকল্পনা সামনে এনেছিলেন, সেই প্রকল্পে যোগ দিতে? তাঁর শব্দচয়ন, উচ্চারণের অভিঘাত, নির্মেদ চিত্রকল্প সে-কথাই তো বলছে:

আসলে, ঝোড়ো বাতাস যে শহরটিকে ঠুকরে বেড়াচ্ছে, সেটি মহানগর, কলকাতা। সেখানে মানুষ, সত্যিকারের মানুষ, মেকি নাগরিককুলের রাস্তাসমূহ খুঁড়ে থামিয়ে দিয়েছে সভ্যতাকে দমিয়ে যাওয়া যান। রাখালের লাশ মাটির অতল থেকে তুলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলেছে, এই সুতানুটি তোমাদের না। ওই যে রাখালটি, বিস্মৃত, তার চারণভূমি ছিল এই স্থল, তার আবাসভূমি ছিল এই সুতানুটির মাটি। তার হারানো আশ্রয় তাকে ফিরিয়ে দাও। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা নয়, শহরের পায়ের নীচে চাকার নীচে চাপা পড়া মৃত-বিস্মৃত গ্রামকে তুলে আনো।

 

Buddhadeb4

 

কবিতার মিতভাষণে অতগুলো নিহিত কথা উচ্চারণ করেও দেখুন, বাহ্যিক অবয়বে কবি কিন্তু নিদারুণ নিস্পৃহ। কখনোই সোচ্চারে বলছেন না যে, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও! কিন্তু অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় বুনে দিচ্ছেন বৈপ্লবিক ওই আহ্বান। শব্দশিল্পীর সাফল্য এখানেই। কবিতাটির শরীরে যেটুকু আহ্বান আছে, তাতেও আগুন ছড়াচ্ছেন তিনি ওই অন্তর্লীন মুন্সিয়ানাতেই:

"দেখ স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে এখন, এগিয়ে চলেছে

দ্রুত পিঁপড়ের সারি পুঁতির মতন সেই পৃথিবীর কোণে,

সেই কোণ ডাক দেয় আমাদের, চলো আরো নিচে নেমে যাই।"

সত্তরের কবিতায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বলিষ্ঠতা যে নির্ভীকতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে, বুদ্ধদেবের কবিতা বরাবর সেই নির্ভীকতারই দোসর। সেই সঙ্গে অসাধারণ এক নিস্পৃহতার বকলমে তিনি হানতেন তীব্র এক কশাঘাত। এই যেমন উল্লিখিত কবিতার শেষ স্তবকে রাষ্ট্রযন্ত্রের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিটির প্রতি হেনেছেন:

"দিনগুলি, যখন মুখ্যমন্ত্রীর স্টাম্প পড়ছে ছিটকে ছয়ের-মার দেখাতে গিয়ে, মৃদু হেসে

তিনি ফিরে যাচ্ছেন অপিস, হাত নড়ে উঠে--শান্ত, সবাইকে শান্ত হতে বলছে,

তাদের চোখের ওপর মুহূর্তেই দ্রুত

নড়ে উঠছে আবার তাঁর হাতে ভাবী পরিকল্পনার অজস্র ব্লু-প্রিন্ট।"

মুখ্যমন্ত্রীর মুখের হাসি আর হাতের শান্তি যে সত্যিকারের না, পরাজয়ে তাঁর কোন ক্লান্তি যে নেই-সেই ঝুলন্ত মুখোশটাই তিনি সপাটে ছিঁড়ে দিয়েছেন এইভাবে। আর এভাবেই তিনি সমে পৌছিয়ে শিল্পিত করে তুলেছেন তাঁর কাব্যের শরীর। আর সেই শরীরের ভিতর প্রজ্ঞার প্রভায় আলোকিত এক কবিকে আমরা সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যাই, যাঁর নাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...