বুদ্ধদেব চরিত

তিরিশের দশকে কলকাতায় কবিতার জন্য আস্ত মাসিক পত্রিকা তেমন ছিল না। শুধুমাত্র কবিতা কেন্দ্রিক সাহিত্য একেবারে চেনা ছকের বাইরে, যা অন্য দিশা দেখাতে পারে কবিতাজীবী মানুষকে। বেশির ভাগ পত্র পত্রিকায় কবিতার জায়গা ছিল গদ্যের পাতার নীচের দিকে। এই ধারার পরিবর্তন চাইলেন তিনি। ভিতর ভিতর ছটফট করতেন। একদিন যেন ভাবনারা দিক পেল।একদিন অন্নদা শংকর রায়ের হাতে একটা পত্রিকা দেখতে পেলেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকার এক আড্ডায়। ইংরেজি পত্রিকা। নাম ‘পোয়েট্রি’

তিনি এ পত্রিকার আদলেই কেবলমাত্র কবিতা নিয়ে বাংলায় সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করার ভাবনা শুরু করলেন করেন। কয়েক বছর পর পত্রিকার ভাবনা দুই মলাটের ভাঁজে ধরা দিল নশ্বর শরীরে।বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘প্রথম চাঁদাটা যে আমিই তুলেছিলাম সেটা ভুলিনি। ... চাঁদার হার পাঁচ টাকা।

কবিতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালের ১ অক্টোবর। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। বুদ্ধদেব বসু সসংকোচে রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁর কথায় : ‘ঈষৎ ভয়ে-ভয়ে এক কপি পত্রিকা পাঠালাম রবীন্দ্রনাথকে, প্রার্থনা করলাম তাঁর একটি কবিতা।’

চিঠি পাওয়ার দুই-তিন দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথ জবাব দিয়েছিলেন।
তিনি ‘কবিতা’ পড়েছিলেন এবং প্রকাশের জন্য দিয়েছিলেন ‘ছুটি’ কবিতাটিও। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘‘তোমাদের ‘কবিতা’ পত্রিকাটি পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। এর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য আছে। সাহিত্য-বারোয়ারি দল-বাঁধা লেখার মতো হয়নি। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে এরা নূতন পরিচয় স্থাপন করেছে।” ‘কবিতা’ পত্রিকার অন্যতম উদ্যেশ্য ছিল কবিতায় নতুন বাতাস নিয়ে আসা। সে বাতাস এর অন্যতম ধর্ম রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত থাকা।

একবার জীবনানন্দের কবিতাকে অনৈতিক ভাবে ‘এডিট’ করার জন্য রবীন্দ্রনাথের সমালোচনাও করেছিলেন ‘কবিতা’র পাতায়। কিন্তু অগ্রজের প্রতি অশ্রদ্ধা ছিল না কোথাও। তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমাদের মাতৃভাষাই তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি’ বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঠিক কী ভাবতেন সেই ছবি উঠে এসেছে প্রতিভা বসুর কলমে,‘‘আমার বিবাহের কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে এসেছেন শুনে বুদ্ধদেব আমাকে নিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হলেন বুদ্ধদেব নববধূ নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়াতে। আমি প্রণাম করে মুখ তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। পা নড়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘মেয়েটিকে তো আমি চিনি গো। তা হলে এই গাইয়ে কন্যাটিকেই তুমি বিবাহ করেছো?’ সামান্য একটু উত্তেজিত হলেই রবীন্দ্রনাথ হাঁটু নাড়াতেন, দাড়িতে হাত বুলোতেন।বুদ্ধদেব বাড়ি ফিরে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগেও দেখা হয়েছে?’আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ‘আমাকে বলোনি তো!’‘কী প্রসঙ্গে বলবো। তুমি তো জিজ্ঞাসা করোনি।’‘এর জন্য প্রসঙ্গ দরকার হয়? জিজ্ঞাসা করার প্রশ্ন ওঠে? রবীন্দ্রনাথকে দেখা শোনা পরিচয় থাকা সবই তো একটা ঘটনা। একটা বলবার বিষয়।’

তাঁর আমন্ত্রণে সপরিবারে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন। আশ্রমে বৃদ্ধ কবিকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল শেষ বয়সের তলস্তয়। নবীনদের প্রতি বুদ্ধদেবের ছিল অনাবিল বাৎসল্য। ২০২ রাসবিহারীর কবিতা ভবন তাই নতুন উঠতি লেখকদের কাছে শুরু থেকে ‘ আমাদের কবিতা ভবন’। ওপেন হাউসের অবারিত দ্বার। রাত বিরেত অবধি যুক্তি- তক্কো- গপ্পে যে বাড়ির মেজাজ সদা জমজমাট। এই তিন বিষয়কে মনন চর্চার জরুরি বিষয় বলে মনে করতেন। অরুণ মিত্র থেকে শুরু করে শক্তি সুনীল নবনীতা। উপভোগ করতেন তরুণ কবিদের সান্নিধ্য। রাত তিনটের সময়ও ফুলের উপহারে চা এর আবদার রাখা যেত তাঁর কবিতা ভুবনে।আজীবন বিশ্বাস করেছেন, শিল্প আর শিল্পীর স্বাধীনতায়। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম। ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কলম তাঁকে ছেড়ে যায়নি।

শেষ দিনটিও সেভাবেই। ১৮ মার্চ। ১৯৭৪। মধ্য যামিনীর চাঁদ তখন জেগে। লিখতে লিখতে হঠাৎ কলম থামিয়ে কলঘরে। আসা- যাওয়ার মাঝে হঠাৎ সেরিব্রালের ছোবল। সেভাবেই স্থির কবি। আর ফেরা হল না লেখার টেবিলে।তথ্য ঋণ( জীবনের জলছবি- প্রতিভা বসু, আনন্দ বাজার পত্রিকা, কালি কলম, বুদ্ধ দেব বসুর ওপর বিভিন্ন পত্র পত্রিকা)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...