ছোট গল্প জিনিসটা কিন্তু বেশ কঠিন একটা বিষয়। মানে কিনা ছোটগল্প লেখাটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছিলেন "....অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে - শেষ হইয়াও হইলো না শেষ..." । একটা উপন্যাস বা বড়গল্প লেখার জন্য একজন সাহিত্যিক অনেকটা সময় ধরে লেখেন, অনেকটা জায়গা নিয়েও। অর্থাৎ তিনি যা বলতে চাইছেন সেটা প্রকাশ করতে অথবা ফুটিয়ে তুলতে তাঁর সেরকম কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। একজন ছোটগল্পকার কিন্তু হাতে গোনা কিছু শব্দ দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারেন অনুভবের এক বিশাল জগৎ। এটা অনেকটা সমুদ্রে ডুবে থাকা আইসবার্গের মতো। যেটুকু জলের উপরে দেখা যায়, জলের তলায় থাকে তার থেকে অনেকটা বেশি অংশ। অর্থাৎ একজন গল্পলেখক অল্প শব্দের মাধ্যমেই পাঠকের অন্তরকে সুখ দুঃখ হাসি কান্নার একটা নতুন দুনিয়ায় পৌঁছে দিতে পারেন। আজ এই নিবন্ধটি লেখা তেমনই একজন সাহিত্যিককে নিয়ে যার লেখা আজও... তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও পাঠকহৃদয়কে উদ্বেলিত করে তোলে। তাঁর ছোটগল্পগুলিতে লক্ষ্য করা যায় মানব জীবনের নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ। বিপুল কৌতূহল, সহমর্মিতায় এবং সমবেদনার সঙ্গে মানব জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছিলেন।
আসুন জেনে নেওয়া যাক এই মানুষটি সম্পর্কে কিছু বিশেষ মজার ঘটনা। তখন তিনি বিহারের সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলে ক্লাস এইটের ছাত্র। সেই কৈশোর বয়স থেকেই ছেলেটির লেখার হাত ভারি ভালো। সেইসময় ‘মালঞ্চ’ নামে একটি পত্রিকায় সেই ছাত্রটির কবিতা ছাপা হল। স্কুলের ছাত্ররা এবং শিক্ষকরা সবাই ছাত্রটিকে নিয়ে গর্বিত এবং উল্লসিত। শুধু খুশি হননি একজন। তিনি স্কুলের হেডপণ্ডিত রামচন্দ্র ঝা। তাঁর ধারণা, এই কবিতা লেখার কারণে সেই ছাত্রটি সংস্কৃত পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে এবং সেই কারণে সে সংস্কৃতে একশোর মধ্যে একশো পায়নি। হুকুম জারি হল, কোনো কবিতা যেন আর না লেখা হয়। ছাত্রটি পড়ল মহা ঝামেলায়। ভারি মুষড়ে পড়ল সে। পথ দেখালেন অগ্রজপ্রতিম সুধাংশুশেখর মজুমদার। তিনি পরামর্শ দিলেন একটা ছদ্মনাম নেওয়া যেতে পারে। তাহলে আর পণ্ডিতমশাই জানতে পারবেন না। ব্যস, সমস্যার সমাধান। সেই ছাত্রটি – যার আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ছদ্মনাম নিল ‘বনফুল’। হ্যাঁ, ইনিই পরবর্তীতে রবীন্দ্র পুরস্কার জয়ী বিখ্যাত সাহিত্যিক বনফুল। কিন্তু ছদ্মনাম নিয়েও খুব একটা সুবিধে হল না। পণ্ডিতমশাই ধরেই ফেললেন শেষমেশ। পণ্ডিতমশাইয়ের প্রশ্ন বলাইয়ের কাছে যে তার সাহস হল কী করে তাঁর নির্দেশ অমান্য করার? এবার বলাইয়ের সত্যি কথা – ‘না লিখে পারি না যে’! এই ছেলের সাহিত্য প্রীতি দেখে আর বাধা দিলেন না পণ্ডিতমশাই। তবে শর্ত দিলেন কয়েকটা সংস্কৃত শ্লোক অনুবাদ করতে হবে। করে দিল বলাই। ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’র মতো নামকরা পত্রিকায় সেই অনুবাদ কবিতা ছাপাও হল। ঠিকমতো পড়াশুনা করবেন বলে কথা দিয়েছিল বলাই। ১৯১৮ সালে স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল।
কিন্তু এমন ছদ্মনাম কেন? উত্তর নিজেই দিয়েছেন লেখক.... 'বন চিরকালই আমার নিকট রহস্য নিকেতন। এই জন্যই বোধহয় ছদ্মনাম নির্বাচন করিবার সময় ‘‘বনফুল’’
নামটা আমি ঠিক করিলাম।'
১৮৯৯-এর ১৯ জুলাই এক প্রবল ঝড়জলের দিনে বিহারের মনিহারিতে হুগলির শিয়াখালা গ্রামের ‘কাঁটাবন মুখুজ্জ্যে’ বাড়ির ছেলে সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী জন্ম দিলেন এক পুত্র সন্তানের। শিশুর নাম রাখা হল বলাই। তাঁর জন্মের পরপরই মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে মায়ের দুধ না পেয়ে বাড়িরই এক মুসলমান মজুর চামরুর বউয়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হল বলাইচাঁদ। শৈশব থেকেই বনজঙ্গল ভালোবাসে সে; সেই দুধ-মায়ের সঙ্গে ছোট ছোট পায়ে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত ছোট্ট বলাই। বনের প্রতি ভালোবাসা হয়তো তখন থেকেই ।
পেশায় ছিলেন তিনি একজন ডাক্তার। বরাবরের স্বাধীনচেতা মানুষটি কোনো বাঁধাধরা চাকরি করতে চাননি বেশিদিন। ডাক্তারি পাশ করার কিছুদিন পর প্যাথলজির ট্রেনিং নিয়ে প্রথমে আজিমগঞ্জ মিউনিসিপালিটি হাসপাতালে অল্প কিছুদিন চাকরি করলেন। তারপর ভাগলপুরে নিজস্ব ল্যাবরেটরি খুললেন বনফুল। ডাক্তারি তাঁর পেশা হলে সাহিত্য তাঁর নেশা। লেখালিখি ও ডাক্তারি দুটোই পাশাপাশি সমানতালে করে গেছেন বনফুল। না লিখে থাকতে পারতেন না; তাই পেশার ব্যস্ততার তাগিদে লেখালিখি কখনোই ছাড়েন নি। কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে এমনিতেই। হাজারের বেশি কবিতা, ৬০টি উপন্যাস, ৫৮৬টি ছোটোগল্প, ৫টি নাটক, আত্মজীবনী, অগুনতি প্রবন্ধ এইসব নিয়ে বনফুলের ২২ খণ্ডে প্রকাশিত রচনাবলীর সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক তাই বিস্মিত হয়ে যান।
এমন সাহিত্যিক যে কবিগুরুর স্নেহের পাত্র হবেন সে আর নতুন কী? যৌবনে এক সময় কলকাতায় এক মেসে থাকতেন। তখনই একবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু পরিমল গোস্বামীকে সঙ্গী করে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে চলে গিয়েছিলেন।
প্রথম আলাপেই থেমে থাকেনি, সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় তার পরেও। তবে বনফুলের সব লেখা যে কবিগুরুর পছন্দ হতো তা নয়। যেমন বনফুলের লেখা উপন্যাস ‘কিছুক্ষণ’ পড়ে উচ্ছ্বসিত কবি উৎসাহ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন । আবার ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটক পড়ে কড়া সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। একবার রবীন্দ্রনাথ বনফুলের লেখা ছোটগল্প "মানুষের মন" পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বললেন, ‘তিনি বনফুলকে কিছু উপহার দিতে চান'। বনফুল উপহার হিসেবে কী চান তাও জানতে চাইলেন। উত্তরে কবির একটি গায়ে দেওয়া পুরনো জোব্বা চাইলেন বলাইচাঁদ। কবি প্রথমে অস্বস্তিতে পড়লেও নাছোড় বলাইচাঁদের আবদার তাঁকে মানতেই হয়। শেষে দামী পশম এবং রেশমের তৈরি একটি জোব্বা নিজে বনফুলের হাতে তুলে দেন।
সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। ভারত সরকারের কাছ থেকে ১৯৭৫ সালে পদ্মভূষণ সম্মান লাভ করেছিলেন। তবে জীবনের সেরা পুরস্কারটি যা পেয়েছিলেন তা হল মানুষের ভালোবাসা। একবার ভাগলপুর থেকে কলকাতায় আসবেন তিনি। খুব জরুরি কাজ ছিল তাঁর। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায় কোনো কারণে। স্টেশনে পৌঁছে দেখেন কলকাতার ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হতাশ বনফুল স্টেশনের একটি বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হঠাৎ চেয়ে দেখেন যে ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেটা আবার পিছিয়ে ফিরে এসে ভাগলপুর স্টেশনে থামল। ট্রেন থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বললেন ".... স্যার, আপনার সব লেখাই আমি পড়েছি।..... আপনাকে দৌড়াতে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কলকাতা যাবার গাড়ি ধরতে আসছেন। আমিই স্যার এই ট্রেনের ড্রাইভার। তাই আপনার জন্যই গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে এলাম। চলুন স্যার, তাড়াতাড়ি চলুন।"......
এই যে পাঠকের অমূল্য ভালোবাসা... এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর একজন সাহিত্যিকের কাছে আর কিছু হয়!
তথ্য ঋণ: ‘স্মৃতিচিত্রণ’: পরিমল গোস্বামী এবং
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহ।।