তাঁর কবিতা স্পর্ধার ভাষায় কথা বলে। স্পষ্ট এবং সোজাসুজি। দ্বিধাহীন। খাপ খোলা তরোয়ালের মতো। বিক্ষুদ্ধ সমকাল। অস্থির সময়। মানুষের জীয়নসংকট। মানবিক অবনমন। এই সবই আয়নার মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লেখনীতে। কাব্যভাষায়। কলম আর তখন শুধু কলম হয়েই থাকেনি, হয়ে উঠেছিল আগুনে প্রতিবাদ। তিরিশের দশকে বাংলা কবিতার অন্যতম মুখ তাঁর কবিতা। রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত। এক নতুন ভাষ্যের কবি বিষ্ণু দে।
তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হতে না পারলে বাংলা কবিতার উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই।”
শুধু বলার মধ্যে আটকে থাকেননি। নিজেই তৈরি করেছিলেন নতুন পথ। জিনের মতাদর্শ, অনুভূতি, দেশকাল নিয়ে ভাবনা, মত প্রকাশ করেছিলেন কলমে।
বিষ্ণু দে লেখেন,
“উন্নত দেশ নই কোনোদিন, দিন আনি খাই,
আমরা কখনো ঘামাইনি মাথা দেশশাসনে,
বিশ্বের কথা দূরে পরিহার করি এ যাবৎ
বিশ্বের ভার এ ঘাড়েই পড়ে প্রাণের বালাই
ঘর থেকে টেনে আনে সংক্রাম দুঃশাসনে,
সূর্যালোকের নগ্নতা পায় তার যত ক্ষত”।
বিশ্বকে ধরেছিলেন কবিতায়। বাংলার জল-হাওয়া ছুঁয়ে তাঁর কবিতার পাশে এসে বসেছিলেন টিএস এলিয়ট। অন্যদিকে মার্কসীয় দর্শন।
বিষ্ণু দের জন্ম কলকাতায়। বাবা অবিনাশচন্দ্র দে। পেশায় উকিল। মা মনোহারিনী দেবী। আদি বাড়ি হাওড়ার পাতিহালে।
তাঁর পুরো বড় হয়ে ওঠাটাই কলকাতায়। জীবনও মহানগর কেন্দ্রীক। বিষ্ণু দের কবিতা তাই নাগরিক ভাষায় কথা বলে। তাতে মিশে থাকে বাংলার লৌকিক জীবনযাত্রা।
“আমার আনন্দে আজ আকাল বন্য প্রতিরোধ,
আমার প্রেমের গানে দিকে দিকে দুস্থের মিছিল,
আমার মুক্তির স্বাদ জানেনাকো গৃধ্নুরা নির্বোধ-
তাদেরই অন্তিমে বাঁধি জীবনের উচ্চকিত মিল”
বিষ্ণু দে’র জীবন আবর্তিত হয়েছে টি.এস.এলিয়টকে কেন্দ্র করে। তিনি ফিরে ফিরে গেছেন বিদেশি এই কবির কাছে। তবে সীমাবদ্ধ হয়ে যাননি। লোরকা, আরাগন, নেরুদা ও প্রভাব ফেলেছিলেন কোনও না কোনওভাবে।
তাঁর লেখনী এবং জীবন ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল রং-তুলির জগতের মানুষদের দ্বারা। কখনও মাতিস, কখনও সেজান, কখনও পিকাসো। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন যে মানুষটির দ্বারা, তিনি রংতাপস যামিনী রায়।
এক সময় বিষ্ণু দে এবং যামিনী রায়ের নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করত বাঙালি। যামিনী রায় এবং তাঁর ছবির প্রতি মুগ্ধতা ছিল বিষ্ণু দে’র। যামিনী রায়’ নামে একটি বইও লিখেছেন। দুজনের মধ্যে স্নেহের সম্পর্ক ছিল।
চিত্রকলার পাশাপাশি গান আর সিনেমা কবির জীবনের অন্যতম আগ্রহের ভারকেন্দ্র ছিল।
ঋত্বিক ঘটক একবার রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটিকে সিনেমায় রূপ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। চিত্রনাট্য লেখার কাজও শুরু হয়েছিল। সেই কাজে ঋত্বিককে সাহাজ্য করেছিলেন বিষ্ণু দে। তবে সে ছবি বাস্তবায়িত হয়নি।