পনের নভেম্বর, নরম আলোর পরিষ্কার আকাশ। বৃহস্পতিবার। ১৮৭৫ সাল। ছোটনাগপুরের রুক্ষ্ম-পাথুরে মাটির জঙ্গলঘেরা মুণ্ডা-জনপদ, 'উলিহাতু' (মতান্তরে, জনপদটির নাম, 'ছিলকাদ্')। সেখানে বাঁশের বেড়ার অসম্পূর্ণ আদিম ঘরে জন্ম হল যে শিশুসন্তানটির, তাঁর নাম রাখা হল, 'বিরসা'। বার ধরে শিশুদের নাম রাখা মুণ্ডাদের রীতি। মুণ্ডারি ভাষায় বৃহস্পতিবারের জাতককে বলা হয়, 'বিরসা'। তাই অবধারিতভাবে 'বিরসা' নামটিই রাখতে হল সদ্যজাতের।
'মুণ্ডা' কথার অর্থ হল, 'মোড়ল'। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মোড়লগিরি মুণ্ডাদের জাতিগত পেশা। তাছাড়া আদিমপ্রথায় কৃষি এবং পশুপালন তাদের সার্বজনীন জীবিকা। জীবিকার প্রয়োজনে তারা ভ্রাম্যমাণ। উপার্জনের স্বল্পতায় তারা হতদরিদ্র। বিরসার ছেলেবেলাটি কাটতে লাগল ভেড়া ও ছাগল চরিয়ে। রাখালি করতে করতে সঙ্গগুণে তিনি শিখে ফেললেন বাঁশি। অর্জন করলেন অপূর্ব সুর তোলার দক্ষতা। শেখার আগ্রহ ছিল তাঁর প্রবল, তাই শিখে ফেললেন শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে তৈরি একতারার মতো এক-তারের বাদ্যযন্ত্র, 'টুইলা'ও। আর তির-ধনুকে তো তাঁর জন্মগত অধিকার।
বাবা সগুনা মুণ্ডার ক্ষমতা ছিল না যে, বিরসাকে লালনপালন করেন। তাঁর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। বিরসার বড়ভাই গিয়ে এক গাঁয়ের মোড়ল হলেন। বিরসা গেলেন মামারবাড়ি, আয়ুভাতু। খ্রিস্টান মিশনারিরা তখন আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে শুরু করেছেন খ্রিস্টধর্মের প্রচার, ধর্মান্তরিত করছেন; পরিবর্তে দিচ্ছেন হতদরিদ্র আদিবাসীদের খাবার ও শিক্ষার স্বল্পকিছু সুবিধে। মামা সেই সুবিধে পেতে খ্রিস্টান হয়েছেন।
যাইহোক, আয়ুভাতু থেকে খানিক দূরে জয়পাল নাগ নামের এক ভদ্রলোক একটি স্কুল করেছেন, মামা বিরসাকে সেখানে ভর্তি করে দিলেন। নামেই ভর্তি। পেট চালাতে বিরসা স্থানীয় এক মহাজনের বাড়িতে ছাগল-ভেড়া চরানোর কাজ নিলেন। দু'বছরের মাথায় একদিন ছাগল-ভেড়ারা ফসলের ক্ষেতে ঢুকে অন্যের ফসল নষ্ট করল। ব্যস, কাজে অমনোযোগিতার অপরাধে মেরেধরে বিরসাকে মহাজন তাড়িয়ে দিল। এবার বিরসা পড়লেন জার্মান মিশনারিদের হাতে। শিক্ষা-অন্ন-কর্মের লোভ দেখিয়ে তারা তাঁকে ধর্মান্তরিত করল। বিরসার নতুন নাম হল, 'বিরসা ডেভিড বা দাউদ মুণ্ডা'। তারা তাঁকে ভর্তি করে নিল তাদের লোয়ার প্রাইমারি স্কুলে।
মিশনারিদের শিক্ষায় ছিল খ্রিস্টধর্মের মহত্ব এবং জগৎব্যাপী এই ধর্মের প্রচার করে ইংরেজ জাতি অধ্যুষিত খ্রিস্টসাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নই বিরসার মনে এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিল। তিনি ভাবলেন, তাঁরও তো নিজস্ব একটি জাতি আছে, সেই জাতির নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে, এবং সেই সংস্কৃতি জন্মগত স্বাধীনতার কথা বলে। তাহলে সেই জাতি ও সংস্কৃতিকে তো রক্ষা করতে হবে, তাদের একত্র করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে তাদের নিয়ে এক অখণ্ড আদিম মুণ্ডা-সাম্রাজ্য। আর সেটা করার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেবেন তিনি। কারণ, তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন একদিকে মিশনারিরা তাঁদের ওপর নিজেদের ধর্ম ও বিশ্বাস চাপিয়ে দিচ্ছে, আদিম মুণ্ডা-সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে; অন্যদিকে দেশীয় মহাজন ও জমিদারেরা মুণ্ডাদের নিজেদের ভূমিতেই ভূমিদাস করে তুলছে। মুণ্ডাদের ভৃত্য করে গোলাম বানিয়ে ফেলছে। মুণ্ডা মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে সম্মান নষ্ট করছে! আর এই অত্যাচারে গাঁটছড়া বেঁধেছে দেশীয় জমিদার-মহাজন-দালালদের সঙ্গে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ইংরেজ কর্মচারীরা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন বিরসা, গা থেকে খ্রিস্টধর্মের চাপানো 'ডেভিড বা দাউদ' ছুঁড়ে ফেললেন, শুরু করলেন জনমত গড়ে তুলতে। ঘোষণা করলেন 'উলগুলান' বা বিদ্রোহ। হয়ে উঠলেন মুণ্ডাদের কাছে, 'ধরতি আব্বা' বা 'জগৎপিতা', মুণ্ডাদের উদ্ধারপ্রয়াসী রক্তমাংসের ভগবান। দর্পিত কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, 'মহারানি রাজ টুন্দু জানা অরো আবুয়া রাজ এতে জানা!' অর্থাৎ 'মহারানির রাজত্ব নিপাত যাক, আমাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাক!'
বিরসার ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা। তিনি মিশনারিদের কাছে শিখেছিলেন যে, ধর্মের নামেও মানুষকে এক করা যায়, যেকোন কাজ করতে প্রবলভাবে প্রণোদিত করা যায়। তাই তিনি নিজেকে ঈশ্বর ঘোষণা করে বললেন যে, ভগবান তাঁকে পাঠিয়েছেন, অত্যাচারীদের শাস্তি দিয়ে ছোটনাগপুরের সমস্ত পরগণায় মুণ্ডারাজ প্রতিষ্ঠা করে মুণ্ডাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। সেটা ১৮৯৫ সাল। মুণ্ডাদের গ্রামে গ্রামে টোলায় টোলায় ঘুরে তাঁদের এই মন্ত্রে এক করে ফেললেন তিনি। চার বছরের চেষ্টায় সমগ্র ছোটনাগপুরে জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম হলেন বিদ্রোহের আগুন।
২৪ ডিসেম্বর ১৮৯৯ শুরু হল উলগুলান। মারণপণ তির-ধনুকের তীব্র ঝলকানিতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল প্রশাসন। চারদিনের দিন রাঁচির ডেপুটি কমিশনার সেনা নামাতে বাধ্য হল। তবুও বিদ্রোহীদের ঠেকানো গেল না। মুণ্ডাঅধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মহাজন, দালাল ও ব্রিটিশের চাকররা ভয়ে পালাতে শুরু করল। তারইমধ্যে ৭ জানুয়ারি ১৯০০ সালে বিরসা-বাহিনী খুঁটি থানায় আক্রমণ করল। তাতে এক বা একাধিক কনস্টেবল মারা গেল। তারই জেরে ১০ তারিখ ব্রিটিশ ও বিরসা-বাহিনীর মুখোমুখি লড়াই হয়ে গেল। কার্তুজের মুখে দাঁড়িয়ে মারা গেলেন হাজারখানেক মুণ্ডাযোদ্ধা। তবুও ব্রিটিশবাহিনী মরণপণ মুণ্ডাদের মনোবল ভাঙতে পারল না। এমনকি বিরসার নাগাল পর্যন্ত পেল না। বাধ্য হয়ে তারা বিরসার মাথার দাম ঘোষণা করল পাঁচশো টাকা। কিন্তু, লোভ দেখিয়েও যখন কাজ হল না, তখন নিরীহ আদিবাসীদের উপর শুরু করল নির্মম অত্যাচার। ব্যবস্থা করল হাতে এবং ভাতে মারার। তারই জেরে কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবের আগুন বুকে নিয়ে ধরা পড়ে গেলেন বিরসা। বিচারে জেল হল। আর এই জেলেই মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ৯ জুন রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন তিনি। কেউ বলল কলেরা, কেউ বলল জ্বর। সত্য রয়ে গেল অধরা। আজও। বিরসা একটা অসম্পূর্ণ বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে অতৃপ্ত হৃদয়ে অকালে চলে গেলেন ঠিকই; তবে যাবার আগে ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতোই মুণ্ডা তথা আদিবাসীদের দিয়ে গেলেন জেগে থাকার মন্ত্র। তারই জেরে স্বাধীনতার সময় ও পরে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে দেশের স্বাধীন সরকার ভাবতে বাধ্য হয়েছিল, এখনও হচ্ছে...
তথ্যঋণ : 'BIRSA MUNDA AND HIS MIVEMENT 1874-1901'- K S SING এবং 'হমারি ভিরাসত' পত্রিকা, উলগুলান শতবর্ষ সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০০০ ।