তিন ভালোবাসা মিলে তৈরি হয়েছিল বীরেন্দ্রভূমি

স্বদেশ।স্বজন।সময়।
এই তিন ভালোবাসা মিলে তৈরি হয়েছিল বীরেন্দ্রভূমি। প্রেম থেকে অপ্রেম, তার কাতরতা, যন্ত্রণা একাকার হয়ে যেত বিক্ষত স্বদেশের টানে। অশান্ত হয়ে উঠত কলম, তবু যেন শেষ পর্যন্ত ভরসা দেয় ভালোবাসায়।
তাঁর স্বপ্নের মধ্যে এক ভারতবর্ষ বাস করত। যে দেশকে তিনি লালন করতেন নিজের বুকের ভিতর। ধারণ করতেন। তাই উচ্চারণ করে উঠতে পেরেছিলেন,
আমার ভারতবর্ষ
পঞ্চাশ কোটি নগ্ন মানুষের,
যারা সারাদিন রৌদ্রে খাটে,
সারারাত ঘুমুতে পারে না
ক্ষুধার জ্বালায়, শীতে।

প্রবাদের আড়ম্বর তিনি চাননি। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত মানুষের মুখের ভাষা। কান্নার অবয়ব। যে লেখনীর নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। ছাত্রজীবন কলকাতার রিপন স্কুল ও কলেজে। কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু আর বিষ্ণু দে’কে। কিন্তু তাঁর কবিতা বয়ে গিয়েছে স্বাধীন সত্তায়।
কথা বলতেন ঢাকার টানে। কবিতা মাথায় এলে আর কোনও দিকে খেয়াল থাকত না। সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন আড়ম্বর। ছুটে যেতেন গ্রামগঞ্জ, মফস্বলে।
কবিতা তাঁর কাছে নিছক কবিতা ছিল না কোনওদিন। কবিতা আসলে অস্ত্র। যা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া যায় আত্মবিস্মৃত দেশের চিন্তা-চেতনা। কবিতায় চেতনাকে তোলপাড় করার মতো শক্তি খুঁজতেন তিনি। পথের মানুষ চকমকি আগুনে জ্বেলে উঠেছে শব্দের আত্মায়।সেই তাঁর জীবনের দর্শন। বীরেন্দ্র লেখেন,
আমার স্বদেশ রক্তবমি করছে, আমার স্বদেশ / রক্তবমি করছে।
তিনি প্রবলভাবে রাজনৈতিক কবি। রাজনীতি বোধের জাগরণটা হয়েছিল কৈশোরেই। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু আদর্শ। স্বপ্ন দেখতেন সমাজতন্ত্রের। লেখার সুরও নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে উঠে আসা। যা মানুষের বেঁচে থাকার কথাই বলে যায়। তাঁর আর কোনও পথ নেই।
প্রেমের কবিতা থেকে প্রতিবাদের কবিতায় তাঁর দিক বদলে অনুঘটক ছিল বহু। একের পর এক ইতিহাস বদলে দেওয়া ঘটনা। দেশভাগ, খাদ্য আন্দোলন, নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল-বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আইন অমান্য, জেল, জরুরি অবস্থা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নকশালবাড়ি আর দুর্দিনের দিন প্রতিদিন।
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম।
কবিতা! তুমি কেমন আছো?
যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ, অপমানে!

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা শুধু কবিতা নয়, তা জোটবদ্ধ মানুষের কণ্ঠ। এক মিছিল থেকে আর এক মিছিলে ছড়িয়ে পড়ে।
নিরন্তর কবি বলে চলেন,
ঘুমাও তুমি ঘুমাও
আর আমি জেগে থাকি এক আরম্ভের জন্য...মৃত্যুর মুখোমুখি...আমি জেগে থাকি

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...