বিমল মিত্রঃ বিড়ম্বিত জীবনের এক অধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে শোনা যায় যে, একই সঙ্গে অনেকগুলো ধারাবাহিকের কিস্তি লেখায় কিংব্দন্তিসুলভ দক্ষতা তাঁর ছিল। তিনি যখন আনন্দ বাজারে চাকরি করতেন, তখন তাঁর ডেস্কেই একে একে বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধিরা হাজির হতেন ধারাবাহিক উপন্যাসের কিস্তি নিতে। সুনীল জিজ্ঞেস করতেন, কতদূর লিখেছি বল তো?

কিস্তিগ্রাহক আগন্তুকেরা মনে করিয়ে দিতেন বিগত পর্বে কাহিনি কোথায় থেমেছে। এই দায়িত্বটা আগন্তুকদের ওপরেই অর্পিত ছিল। তারপর লহমা ভেবে নিয়ে তাঁদের কাউকে সুনীল আধ ঘণ্টা, কাউকে বা ঘন্টাখানেক বসতে বলতেন।

এবং কী আশ্চর্য, সেই নির্দিষ্ট আধ বা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কিস্তি ধরিয়ে দিতে পারতেন তিনি। এটা দারুণ একটি গুণ এবং চরম পেশাদারিত্বের নিদর্শন।তবে এই পেশাদারিত্বে বঙ্গ সাহিত্যের লেখককুলের মধ্যে তিনিই প্রথম পুরুষ নন, তাঁর একজন পূর্বসূরি রয়েছেন। তিনি, প্রখ্যাত কথাকার বিমল মিত্র।       

পাঁচের দশকে কথাকার হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বিমল মিত্র। সেই জনপ্রিয়তার মাশুল দিতে হয়েছিল তাঁকে অনেকভাবেই। সাহিত্য বা পাঁচমিশালী পত্রিকার প্রাণ হচ্ছে ধারাবাহিক উপন্যাস। পাঠক গল্প পড়তে ভালোবাসেন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যিকের লেখা হলে তো কথাই নেই।

‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ধারাবাহিক উপন্যাস বিমল মিত্রকে জনতার হৃদয়ে চিরদিনের আসনে বসিয়ে দিয়েছিল। আপামর পাঠক এই উপন্যাসের প্রতিটি কিস্তি পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। শুধু তাই নয় তাঁদের কাছে পত্রিকার স্ট্যান্ড হয়ে উঠত পাঠাগার, চায়ের দোকান হয়ে উঠত সাহিত্যের আড্ডাখানা। একটা উপন্যাস নিয়ে এবং একজন ঔপন্যাসিককে নিয়ে এই যে উন্মাদনা, এটা আজকের দিনে হয়তো গল্পকথা মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই ছিল সেদিনের সত্য।

তখন একটা উপন্যাসের ভাললাগা চরিত্রের করুণ পরিণতি পাল্টে দেওয়ার দাবি নিয়ে পাঠক লেখকের কাছে চিঠি লিখতেন, প্রিয় ধারাবাহিক শেষ হয়ে গেলে সম্পাদকের দপ্তরে চিঠি লিখে দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আব্দার জানাতেন।আর এই ব্যাপারগুলোই বিমুল মিত্রের বেলায় আকছার ঘটত।পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলার এমনই ছিল তাঁর আশ্চর্য জাদুকরী ক্ষমতা। নিছক কলমের জোরেই তিনি ছিলেন এমন তুমুল জনপ্রিয়।এমন হয়েছে যে, পাঠকের চাহিদায় সাময়িকের পাতায় অন্য লেখকের ধারাবাহিক থামিয়ে তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করতে হয়েছে।

তো, সেই জনপ্রিয়তার জন্য ‘দেশ’ থেকে শুরু করে ‘নবকল্লোল’, ‘ঘরোয়া’ প্রভৃতি বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোতে তাঁকে একইসঙ্গে লেখা চালিয়ে যেতে হয়েছে।এমনও হয়েছে যে, কিস্তি নেবার জন্য পত্রিকার প্রতিনিধিরা লাইন দিয়ে বসে আছেন। তিনি একে একে কিস্তি লিখে তাঁদের ক্রমান্বয়ে বিদায় দিয়েছেন। তবে আগের কিস্তি কোথায় শেষ হয়েছে, সেটা মনে করিয়ে দেবার দায়িত্ব কাউকে তিনি দেননি কখনো। বরং কিস্তি দেওয়ার আগে একটা খাতায় তা নিজেই লিখে রাখতেন।

আজকাল ইতিহাসনির্ভর ও গবেষণাধর্মী উপন্যাস রচনার ব্যাপক জোয়ার এসেছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে শুরু করে আরও চল্লিশ বছর ধরে বিমল মিত্র যে-সব ইতিহাস নির্ভর কাহিনি রচনা করেছেন, তাতে ইতিহাসকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। আর তার জন্য ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে দিনের পর দিন গিয়ে তথ্য সংগ্রহের যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন, তা অনুকরণযোগ্য। শেষ যৌবনে বসন্ত রোগে তাঁর বাম চোখটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তবু এই প্রতিবন্ধকতা তাঁর গবেষণা-নিষ্ঠা, সাহিত্য রচনার অশ্বগতির পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।

নগর কলকাতার দুশো বছরের ঐতিহাসিক জীবন নিয়ে পাঁচখানি উপন্যাস তিনি রচনা করেছিলেন। ১৭৫৭ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত এই সুবিশাল কালখণ্ডকে তিনি ধরেছিলেন ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’, এবং ‘চলো কলকাতা’-এই পাঁচটি ধ্রুপদী উপন্যাসে। ধ্রপদী উপন্যাসের বিস্তারকে তিনি ধ্রপদী সঙ্গীতের রাগ বিস্তারের মতো মর্যাদা দিতেন। তাই তাঁর সুললিত রচনার পংক্তিতে পংক্তিতে পাঠক আজও উপলব্ধি করেন সঙ্গীতের মাধুর্যময় ঐশ্বর্য।

যে সুবিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিমল মিত্র, তার বিড়ম্বনা থেকেও তিনি নিস্তার পাননি। কেননা, তাঁর জনপ্রিয়তার জোয়ারে ব্যবসায়িক লাভ ওঠাতে বাংলা সাহিত্য জগতে আরও কয়েকজন সমনামী বিমল মিত্রের আবির্ভাব ঘটে গিয়েছিল। তারই জেরে আসল বিমল মিত্রের ওপর নকলের বাজে লেখার দায়ভার বর্তাতে শুরু করল, পাঠক প্রতারিত হতে শুরু করলেন। ফলে আসল বিমল মিত্রকে বিড়ম্বনার এই পাকচক্র থেকে বাঁচতে প্রতিটি গ্রন্থে আপন সই ছাপাতে হল ও বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হলঃ

‘আমার পাঠক-পাঠিকাবর্গের সতর্কতার জন্যে জানাই যে, সম্প্রতি অসংখ্য উপন্যাস ‘বিমল মিত্র’ নাম যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক-মহলে আমার জনপ্রিয়তার ফলেই এই দুর্ঘটনা সম্ভব হয়েছে। ও-নামে কোনও লেখক সত্যিই আছেন কিনা ঈশ্বর জানেন। তিনি যদি সত্যিই সশরীরে বিরাজ করেন তো লোক-সমাজে হাজির হয়ে তাঁর সোৎসাহে ঘোষণা করা উচিত। যা’হোক আপাতত অপরের প্রশংসাও যেমন আমার প্রাপ্য হওয়া উচিত নয়, অপরের নিন্দা প্রসঙ্গেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। অথচ প্রায় প্রত্যহই আমাকে সেই দায় বহন করতে হচ্ছে। পাঠক-পাঠিকাবর্গের প্রতি আমার বিনীত বিজ্ঞপ্তি এই যে, সেগুলি আমার রচনা নয়। একমাত্র ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ছাড়া আমার লেখা প্রত্যেকটি গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর মুদ্রিত আছে।’ (বিজ্ঞপ্তির তলায় বিমল মিত্রের নমুনা সই)।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর একাধিক ‘বিমল মিত্রের’ উৎপাত বন্ধ না-হলেও পাঠক সচেতন হয়েছিলেন, আসল বিমল মিত্র বিড়ম্বনার হাত থেকে অন্তত বেঁচেছিলেন। তবু খ্যাতির বিড়ম্বনা সহজে কী মেটে!        

খ্যাতির শীর্ষ ছোঁয়া বিমল মিত্র ‘ছাই’ উপন্যাস দিয়ে কথাকারের পথ পরিক্রমা শুরু করে ‘এই নরদেহ’, ‘আসামী হাজির’, ‘পতি পরম গুরু’, ‘স্ত্রী’, ‘সরস্বতীয়া’, ‘নফর সংকীরতন’-এর মতো প্রায় শতাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস রচনা করেছেন; লিখেছেন ‘নীলনেশা’, ‘আমেরিকা’, ‘জেনানা সংবাদ’, ‘রানীসাহেবা’, ‘আমৃত্যু’, ‘এক রাজার ছয় রানী’ প্রভৃতি প্রায় পাঁচশো ছোটগল্প। তাঁর গল্প-উপন্যাস পাঠক মহলের জনপ্রিয়তা পেরিয়েও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রেও রূপান্তরিত হয়েছে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘স্ত্রী’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ প্রভৃতি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। হয়েছে জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিকও।

এত জনপ্রিয়তা ছুঁয়েও আপামর পাঠকের কাছে আজ তিনি সুদুরের নাম। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’তে তিনি বিস্মৃতপ্রায় আজ। তাঁর উপন্যাসের কিছু পাঠক এখনও রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ছোটগল্পের বিপুল সমৃদ্ধ ভাণ্ডারটির খোঁজ আর তেমন কেউ রাখেন না।জনপ্রিয়তা কালের নিরিখে পারদের মতো ওঠে-নামে, অনেকটা এখনকার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে; অবশ্য তাতে ইতিহাস পাল্টে যায় না, কিংবদন্তী কিংব্দন্তীই থেকে যান; ঠিক সেভাবেই বাংলা কথাসাহিত্যে ধ্রুপদী, কিংব্দন্তী ও চিরস্মরণীয় কথাকার হয়ে রয়ে গেছেন বিমল মিত্র…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...