কলকাতার আর বাঙালিয়ানার প্রতি অদ্ভুত এক ভালোবাসা ছিল, দুর্বলতা ছিল শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের। অফুরন্ত ভালোবাসার জন্যই সুযোগ সত্ত্বেও কলকাতা ছেড়ে কোত্থাও কখনও যাননি তিনি; আজীবন কলকাতায় বসেই শিল্পচর্চা করে গেছেন। বাঙালিয়ানার প্রতি সচেতনভাবেই দুর্বল ছিলেন বলেই বাঙালির হারিয়ে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া মুহূর্তের মাত্রাগুলিকে চিত্রে যেমন তুলে এনেছেন, তেমনি তা নিয়ে লিখেছেন বইও, ‘পুজোর কলকাতা’ নামে।
বিকাশ ছবি আঁকতেন সারারাত। আঁকার সময় চলত অখিলবন্ধু ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙালিশিল্পীদের বাংলা গান। হিন্দি গান শুনতে তিনি পছন্দ করতেন না। নিজের তো বটেই, ছেলেমেয়েদের কথাতেও বাংলা-হিন্দি-ইংরিজির বুকনি একদ্ম পছন্দ করতেন না। এমনই ছিল তাঁর বাংলা ও বাংলা ভাষার প্রতি টান।
শিল্পী হিসেবে বোহেমিয়ান একেবারেই ছিলেন না বিকাশ। আর-পাঁচজন বাঙালিবাড়ির কর্তার মতোই ছিল তাঁর জীবন। শিল্পের দোহাই দিয়ে সেই জীবনের ব্যতিক্রম ঘটতে দেননি তিনি। ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়মিত মাছ-সবজি-মুদির দোকান থেকে বাজার করতেন, করতেন নিজের সব কাজ নিজেই। ফলে, চলনে-বলনে-যাপনে বাঙালিয়ানাকে কখনই ব্যাহত হতে দেননি তিনি।
বিকাশ ভট্টাচার্যের জন্ম উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে। সেই হাতিবাগান ছেড়ে কখনই দক্ষিণে যাওয়ার কথা ভাবতে পারতেন না। ফলে, উত্তর-কলকাতার আর-পাঁচজনের মনে উত্তরের প্রতি যে দুর্বলতা থাকে, সেটা তাঁরও ছিল। এটাও আসলে তাঁর যাপিত বাঙালিয়ানারই একটি দিক।
বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা ‘ডল সিরিজ’ খুব বিখ্যাত শিল্পরসিক ও শিল্প-ব্যবসায়ীদের কাছে। এই সিরিজে তিনি স্থবির বাঙালির আত্ম-অনুসন্ধানের বিবরণ তুলে ধরেছেন এক নিগূঢ় সাংকেতিক ভাষায়।
সময়টা গত শতকের সাতের দশক। কলকাতায় তখন নকশাল আন্দোলনের আগুন দাবদাহের রূপ নিয়েছে। চলছে হত্যা বনাম হত্যার লীলা। সেই ঘটনাগুলো পত্রিকার পাতায়, পাড়ার অশান্ত হাওয়ায় উড়ে কাউকেই স্বস্তি দিচ্ছিল না। কাউকেই নিস্পৃহ থাকতে দিচ্ছিল না। বিকাশও পারেননি নিস্পৃহ থাকতে। তাকে তুলে ধরেছিলেন তুলির আঁচড়ে।
আসলে, সেই ছ’বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর একলা মায়ের আগলে রাখা আশ্রয়ে তাঁর বড় হওয়া। এভাবে বড় হওয়ার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। দারিদ্র্য আর সামাজিক অভিঘাতে এভাবে বড় হওয়ায় কৈশোর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর আত্মার অনুসন্ধান। নিজেকে জানা আর নিজেকে আবিষ্কারের যে যন্ত্রণা, সেটা এভাবে বড় হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে সহজেই বেরিয়ে এসেছিল তাঁর জীবনে।
আর অর্জিত সেই সূত্র ধরেই তিনি সাতের দশকে বাঙালির আত্মাকে খুঁজতে চেয়েছিলেন। কেননা, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ বিশ বছর সময়কালটিকে বাঙালি যেন শান্তির নীড় ভেবে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল, হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখার বাসনাও। সে যেন পুতুল হয়ে উঠেছিল নিজের কাছেই নিজের খেলার ঘরে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির পুতুল হয়ে উঠেছিল। নিজেদের অবস্থানটি নিয়েও ভাবতে ভুলে গিয়েছিল। এদের উদ্দেশ্যেই ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো!’
এই প্রেক্ষাপটে বাঙালি সত্তরে এসে যেন পুতুলের প্রতীকে নিজের হারানো আত্মাকে খুঁজছে। নিজের প্রতিবাদী সত্তাকে খুঁজছে। খুঁজছে নিজের হারানো অবস্থানটি। চাইছে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করেও প্রতিবাদের স্বরটি জাগরিত করতে। তাই তাঁর এই সিরিজের ছবিতে আমরা দেখতে পাই--একটি পুতুল লাল সূর্যের সামনে চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে, পুতুলেরা লাল রঙে মহাকরণে মহাকালের দেওয়াল লিখন পড়ার চেষ্টা করছে—এমনধারা অসংখ্য প্রতীকী চিত্র। এই অনুসন্ধান আসলে বিকাশের বাঙালিয়ানার প্রতি দুর্বলতারই একটি দিক।
বিকাশের আক্ষেপ ছিল যে, বাঙালি শিল্পসমালোচকেরা তাঁর ছবি পুরোপুরি বুঝতে পারেননি, তাঁর ছবির দর্শকেরাও না। বাঙালি চিত্রক্রেতারা তো নয়ই। তবে আর যাই হোক, আপামর বাঙালি শিল্পসচেতন মানুষ, দর্শক, পাঠক তাঁকে ভালবেসেছিলেন; তাঁর শিল্পকলাকে ভালবেসেছিলেন। তাই তাঁরা পত্রিকার পাতায় তাঁর রচিত অলংকরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন, তাঁর রচিত প্রচ্ছদ বাঁধিয়ে রাখার কথা ভাবতেন (তাঁর রচিত প্রচ্ছদওয়ালা পুরনো পত্রিকা হাতে পেলে আজও ভাবেন); তাই আজও ‘দেখি নাই ফিরে’র প্রচ্ছদে সমরেশ বসুর নামের সঙ্গে জ্বলজ্বল করে ‘বিকাশ ভট্টাচার্য চিত্রিত’…