আপোষহীন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় 'নীলকণ্ঠ তুমি, তুমি অভিমন্যু' কবিতায় বিজন ভট্টাচার্যকে নিবেদন করে বলেছিলেন:

"অস্তিত্বের বড়ো কাছে, হে প্রিয়, তোমার আক্রমণ।

বঙ্গরঙ্গভূমি রক্তে ভেসে গেছে সেদিন, একদা--

তুমি তরবারি নিয়ে নেমেছিলে সন্ধ্যায় প্রভাতে।"

 

উচ্চারণটি বিজন ভট্টাচার্য সম্পর্কে একেবারেই যথার্থ। কেন যথার্থ, তা তাঁর জীবন-সারণির দিকে তাকালেই আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি। আমরা জানি, নাটককার-অভিনেতার হাতে ধাতুর তরবারি থাকে না সত্য, তবে তিনি যদি শক্তিমান হন, তাহলে তাঁর কলম, তাঁর অভিনয়ও নির্মম তরবারি হয়ে ওঠে। বিজন ছিলেন তেমনই যোদ্ধা। শিল্পে বিপ্লবী।

বিপ্লবের বছরই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। রুশ বিপ্লবের বছরে। জন্মস্থান ফরিদপুরের খানখানাপুর গ্রাম। সেখানে পিতা ক্ষীরোদবিহারী শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু থিতু ছিলেন না। ফলে শিক্ষকতাসূত্রে সেখান থেকে বসিরহাট, বসিরহাট থেকে সাতক্ষীরা, সাতক্ষীরা থেকে মেদিনীপুর। স্বভাবতই পিতার সঙ্গে পরিবারের এবং পরিবারের সঙ্গে অবধারিতভাবেই বিজনেরও হয়ে উঠেছিল ভ্রাম্যমাণ জীবন। তবে এই জীবন তাঁর ছোটবেলাকে সমৃদ্ধ করেছিল। এই জীবন তাঁকে জনতার সান্নিধ্য দিয়েছিল। পিতার কাছে তিনি যেমন দশ বছর বয়সেই শেক্সপিয়র আওড়াবার শিক্ষা পেয়েছিলেন, তেমনি অবাধ স্বাধীনতাও পেয়েছিলেন জনজীবনের সঙ্গে নির্বিবাদে মেলামেশার।

মেলামেশা করতে গিয়ে অত্যন্ত কাছ থেকে বিজন জেলের জীবন দেখেছিলেন, সাপুড়ের জীবন দেখেছিলেন, চাষার জীবন দেখেছিলেন, ভিখারির জীবন দেখেছিলেন, আউল-বাউলের ঘনিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। এর ফলে জীবন সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা যেমন তাঁর হয়েছিল, তেমনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রান্তিক মানুষকে 'মানুষ' বলে ভালোবাসতেও শিখেছিলেন।

সেই জন্যই বামপন্থার ধারায় এসে যখন জনজাগরণের দাবিতে কলম ধরলেন, তখন একমাত্র এই চেনা জগতটিকেই উপজীব্য করে তুললেন। তাঁদের দাবিকে যুগের দাবি করে তুললেন। আর তাতেই এই প্রথমবার প্রান্তিক মানুষগুলো তাঁদের নিজস্বতা নিয়ে নাট্যসাহিত্যে সত্যিকারের জায়গা পেয়ে গেলেন। আর, সাহিত্যের ধারাতেও যুক্ত হল নতুনত্ব।

তবে সাহিত্য করতে এসে প্রথমেই নাটককার হতে চাননি বিজন। হয়েছিলেন দায়ে পড়ে, যদিও সে দায় অন্য দায়। প্রান্তিক মানুষের কথা, প্রান্তিক মানুষের মুখ দিয়ে বলানোর দায়; শোষকের অত্যাচারে জীর্ণ তাঁদের জীবন জোট বাঁধার গানে জাগিয়ে তোলার দায়, আপাত অসহায়তার মাঝে লুকিয়ে থাকা তাঁদের প্রবল প্রতিবাদী সত্তাটিকে চিনিয়ে দেওয়ার দায়।

দায়িত্ববোধের শুরুটা হয়েছিল অবশ্য অহিংস আন্দোলনে অংশ নিয়ে। তারপর 'আনন্দ বাজার পত্রিকা'য় শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরতে। সেটা গত শতকের তিনের দশক।

এই দশকেরই শেষদিকে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভাবী নৈরাজ্যের আগ্রহে সাধারণ মানুষের ওপর বেড়ে গিয়েছিল ধান্দাবাজদের আরও কয়েকপ্রস্থ বঞ্চনার কালো পরত। 'অরণি', 'অগ্রণী' প্রভৃতি প্রগতিশীল পত্রিকায় একে একে প্রকাশিত তাঁর গল্প ও ফিচারমালা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল সময়ের দলিল।

যুদ্ধকবলিত বিশ্বের আকাশে ফ্যাসিবাদের সর্বগ্রাসী শকুন যখন চক্কর কাটছিল, তখন সেই অপশক্তির দিকে প্রতিবাদ ছুঁড়ে দিয়ে স্থাপিত হয়েছিল, 'ফ্যাসী বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ'। বিজন সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ফলে তাবৎ প্রগতিশীল তরুণ লেখক ও শিল্পীদের সঙ্গে তিনিও সংঘে যুক্ত হয়েছিলেন।

ফ্যাসিবাদকে ঠেকাতে সংঘ অচিরেই অনুভব করেছিল জনজাগরণের গান নিয়ে জনতার কাছে পৌঁছনোর কথা। আর এই তাগিদ থেকেই গড়ে উঠেছিল 'গণনাট্য সংঘ'। সংঘের তরফে তরুণ লেখকদের বলা হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী নাটক লিখতে। তারই প্রেক্ষিতে বিজন লিখেছিলেন 'আগুন'। তখনই সকলে বুঝেছিলেন, বিজনের হাতে উদ্যত শানিত তরবারি আছে, যে তরবারি আঘাত করে শ্রেণি-শোষণের আঁতুড়ঘরে। সেই তরবারি তীব্র ফলাতেই একে একে উন্মুক্ত হয়েছিল 'জবানবন্দী''নবান্ন'

সেটা ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ। 'নবান্ন' অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। মন্বন্তর পীড়িত গ্রাম ও যুদ্ধের কালোছায়া ঘেরা কলকাতার এমন মর্মস্পর্শী অথচ বাস্তব ছবি আর-কেউ আঁকতে পারেননি বিজনের আগে। সেদিন এভাবেই তিনি একাই পৌরাণিক-ঐতিহাসিক পালামুখর নাট্যাঙ্গনের অভিমুখ হঠাতই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন রূঢ় বাস্তবতার পথে, তাঁর এই পথেই অচিরে পড়তে শুরু করেছিল দিকে দিকে সাহসী পদক্ষেপ।

পথ চলতে চলতে পায়ে পা বাধলে সংঘাত হয়। বিজনেরও হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। আসলে, গান্ধিজির রাজনৈতিক পথটিকে  তিনি অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। ছাত্রজীবনে কতবার তাঁর আহ্বানে মিছিলে হেঁটেছিলেন বিজন। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর গান্ধিজি যখন নোয়াখালি গিয়েছিলেন, তখন পার্টির কাছে বিজন অনুরোধ রেখেছিলেন গান্ধিজির মিছিলে যোগ দেওয়ার। কিন্তু বিজনের  সেই অনুরোধ 'ভাববাদী' তকমা দিয়ে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

ব্যাপারটা বিজনকে দারুণ আঘাত করেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, আর যাই হোক, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে রাজনীতি করাটা কোন সুস্থতার পরিচায়ক নয়। মূল কথা যদি হয়, গণজাগরণ; তাহলে সেখানে একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত 'গণজাগরণ'-ই, অন্য কিছু না। মূল্যবোধ ও আদর্শের এই প্রকাশগত বৈষম্যে ফলেই পার্টির সঙ্গে, সংঘের সঙ্গে ক্রমে তাঁর দূরত্ব বেড়েছিল। তারই জেরে অল্পদিনেই তিনি গণনাট্য ছেড়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব নাট্যগোষ্ঠী 'ক্যালকাটা থিয়েটার'।

গণনাট্য সংঘে বিজন প্রবলভাবে যে প্রান্তিক, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের কথা বলতে শুরু করেছিলেন, তারই বিস্তার ঘটেছিল 'ক্যালকাটা থিয়েটার'-এ 'মরাচাঁদ', 'কলঙ্ক', 'গোত্রান্তর', 'ছায়াপথ', 'দেবীগর্জন' প্রভৃতি নাটক রচনা ও প্রযোজনার মধ্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, তাঁর কাছে মত-পথ সবই নির্ধারিত হয়েছিল একটাই দায় থেকে, যেখানে মানুষের প্রতি কমিটমেন্টটাই আসল। এ-ব্যাপারে একটা ঘটনার কথা বললেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে:

ছয়ের দশকের শেষদিক। বিজন ও তাঁর দল মজ:ফরপুর গেছেন 'দেবীগর্জন' নাটক করতে। কিন্তু স্টেজে উঠবার আগেই লোডশেডিং হয়ে গেল। জানা গেল, কয়েকঘন্টার আগে এ-সমস্যা কাটবার নয়। দলের অনেকেই মুষড়ে পড়লেন, তাহলে কি নাটক হবে না? অনেকেরই মাথায় হাত উঠল। তারই মাঝে বিজন কিন্তু অবিচল। তিনি খান দুয়েক হ্যাজাক জোগাড় করিয়ে স্টেজে টাঙিয়ে দিলেন। আর আনিয়ে নিলেন গণ্ডা কয়েক হ্যারিকেন।

তাঁর নির্দেশমতো সুবিধে অনুযায়ী হ্যারিকেন হাতে নিয়ে চরিত্রেরা স্টেজে উঠে অভিনয় করলেন, হাতের হ্যারিকেন তুলে অভিনব কায়দায় মুখের অভিব্যক্তি দর্শকদের দেখার সুযোগ দিলেন। এভাবেই সম্পন্ন হল নাটকের অভিনয়। মঞ্চে আলোর কারিকুরি রইল না, মুড লাইটের সুযোগ মিলল না, প্রেক্ষাপটের আঁকা-সিন প্রস্ফুটিত হল না, পরিচালক নির্দেশিত অভিনয়ের গতটিও বদলে গেল; তবু অভিনয় হল, যাঁদের জন্য এ-নাটক, তাঁদের কাছে প্রতিরোধের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া গেল।

তাই বলছিলাম যে, বিজনের কাছে ছিল কমিটমেন্টটাই আসল। আর তাই যুগে যুগে যখনই জনজাগরণের প্রয়োজন হবে তাঁর সৃষ্টি স্মরিত হবে, যতদিন শ্রেণিসংগ্রাম চলবে তাঁর সৃষ্টি প্রাণিত করবে। কারণ, নাট্যকার বিজন অত্যন্ত সৎ। সেই সততার জন্য তিনি সঙ্গ-সংঘ সব ছাড়তে পেরেছিলেন, রচনা করেছিলেন এক সংগ্রামী পথ...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...