বিস্মৃতির বিজনে বিজন ভট্টাচার্য

তিনি বলতেন, শিল্পীর যে সজ্ঞান বোধ চাই, সেই বোধের কোনও শর্ট ‘কাট’ নেই৷
এই বোধই শিল্পী আর শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবন দেয়। তার সংস্পর্শে এসে মানুষ বাঁচে। জীবন পায়। বদলে যায় তার দেখা আর বিশ্বাস। এই গতির পথ বদলায় না। বিজন ভট্টাচার্য তেমনি এক মানুষ। যিনি আধমরা দের ঘা মেরে বোধিদান করতে চেয়েছিলেন।
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। শম্ভু মিত্রের ভাষায় তিনি কবি। তাই রঙচঙে রাংতা জরির সাজ টান মেরে খুলে বাংলা নাটককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন এক খাঁ খাঁ প্রান্তরে। নিরন্ন মানুষের আর্তনাদ আর দহনের মাঝখানে। সেখানে কোনও ম্যাজিক রিয়েলিটি কাজ করেনা। এপিক নাটকের ব্যাপ্তি উঠে এসেছিল ‘নবান্নে’।
১৯৪৪ সালে লিখলেন ‘নবান্ন’। এই নাটকের জন্ম প্রসঙ্গে বিজন লিখেছেন,
একদিন ফেরবার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে এখন কী হচ্ছে। আমি আমার ফর্ম পেয়ে গেলাম।"
নবান্ন মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বাংলা নাটকের। নিজের চোখে দেখা পৃথিবীটাকে মঞ্চে তুলে এনেছিলেন। যে কথা বলবে প্রান্তিক মানুষের স্বরে। যাদের তিনি দেখেছেন পথে, ঘাটে, রাস্তায়, গ্রামে-গঞ্জে। এই দেখা বিজনের ছোট্ট বেলা থেকেই সঙ্গী।
জন্ম ১৯১৫ সালের ১৫ জুলাই। বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের খানখানাপুরে ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে। বাবা ক্ষীরোদবিহারী। মা সুবর্ণপ্রভা
খানখানাপুর সুরাজমোহিনী ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবা।
জমিদারির বিষয়ে কোনওদিনই তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। দেশ ভাগের বহু আগেই পুত্রকে নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার আড়বেলিয়ায়।
১৯৩০ সালে কলকাতায় আসেন বিজন।
প্রাথমিক স্কুলের পড়া শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন আশুতোষ কলেজে। পরে রিপনে। পড়াশুনা চলতে চলতে ধাক্কা দেয় রুশ বিপ্লব। বামপন্থী রাজনীতির টানে ভেসে যান।
১৯৩৮-এ আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করেন সাংবাদিক হিসাবে।
অরণি' পত্রিকায় ১৯৪৩-এ প্রকাশিত হল বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক 'আগুন'। সেই নাটকেও বিপণন মানুষের হাহাকারের ছবিই তুলে ধরে ছিলেন।
তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) । বাংলা নাটকের দিক বদলে দেওয়া নাটক। ঐতিহাসিক দলিল।
ঋত্বিক ঘটক নবান্ন সম্পর্কে বলেছিলেন,
"বিজনবাবুই প্রথম দেখালেন কি করে জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়, কি করে সম্মিলিত অভিনয়-ধারার প্রবর্তন করা যায় এবং কি করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ডরূপ মঞ্চের উপর তুলে ধরা যায়।
নবান্ন ছাড়াও বিজন ভট্টাচার্য রচিত নাটকের তালিকায় প্রায় সমস্ত নাটকে মানবিক বোধই মুখ্য চরিত। ‘মরা চাঁদ’ (১৯৪৮, প্রথমে একাঙ্ক, ১৯৬০-এ পূর্ণায়িত), ‘অবরোধ’ (১৯৪৭), ‘জতুগৃহ’ (১৯৫১), ‘গোত্রান্তর’ (রচনা ১৯৪৭, ১৯৫৬-৫৭), ‘ছায়াপথ’ (১৯৬১), ‘দেবীগর্জন’ (১৯৬৬), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬), ‘গর্ভবতী জননী’ (১৯৬৯-৭১), ‘আজ বসন্ত’ (১৯৭০), ‘সোনার বাংলা’ (১৯৭১), ‘চলো সাগরে’ (১৯৭২)।
রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপও দিয়েছিলেন তিনি। আকাশবাণীর জন্য লিখেছিলেন গীতিনাট্য ‘জীয়নকন্যা’ (১৯৪৮)।
তিনি নট, নাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং দক্ষ সুরকারও ছিলেন৷
তবু বাংলা আধুনিক নাটক চর্চায় তিনি যেন ব্রাত্যই থেকে গেলেন শেষ দিন অবধি। ইতিহাস তাঁকে ভুলেছে। বঙ্গভূমিতে বিস্মৃতির অন্তরালে আজ তিনি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...