বিভূতিবাবুর ভোজনবিলাস

কলকাতার সাহিত্যিক মহলে তাঁর নাম ছিল নামকরা খাইয়ে হিসেবে। যে কোনও আডায় খাওয়ার কথা উঠলেই সতীর্থ সাহিত্যিকরা এক বাক্যে মানতেন তাঁর এলেমের কথা। ‘ হ্যাঁ, খেতে পারতেন বটে বিভূতিবাবু’
তাঁর ভোজন বিলাস নিয়ে নানা রকম গল্প চলত সে সব আড্ডায়।
একবার কলকাতা থেকে সাহিত্যিকদের একটি দল মেদিনীপুর গেলেন। সাহিত্যবাসরের আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। সাহিত্যিকদলের দলপতি বিভূতিভূষণ।
উদ্যোক্তারা খড়্গপুর স্টেশনে এসেছেন তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। দলপতি বিভূতির পিছন পিছন চলেছেন বাকিরা। হঠাৎ দেখা গেল এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কী যেন আলোচনা চলছে। বাকিরা ভাবল অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা চলছে বোধহয়। কিন্তু জানা গেল, সেদিন দুপুরের মেনু কী সেই নিয়েই চলছিল গম্ভীর কথাবার্তা।
সেদিন দুপুরের খাওয়া খেতে খেতে হঠাৎই জানালেন, ‘ মেদিনীপুরের কাঁকড়ার ঝোল নাকি খুব ভালো খেতে’
দুম করে উদ্যোক্তাদের বলে ফেললেন, ‘ কাল তো রবিবার, কাল দুপুরে আপনারা কাঁকড়ার ঝোল খাওয়াতে পারেন?’
উদ্যোক্তারা প্রস্তুত ছিলেন না এমন আবদারের জন্য। সাহিত্যিকদের দলপতিকে জানালেন, ‘ আগে খবর পেলে লোক লাগিয়ে ভালো জাতের কাঁকড়া সংগ্রহ করে রাখতাম’
কিন্তু পিছোপা হলেন না তাঁরা। জানালেন অতিথিদের কাঁকড়ার ঝোল তাঁরা খাওয়াবেনই।
রাতে এক বড় হল ঘরে শুয়েছেন সাহিত্যিকরা। হঠাৎ কানে এলো খড়খড় আওয়াজ।
ইঁদুর নাকি? জামাকাপড় কেটে নষ্ট করবে না তো?
এসব বাতচিত যখন চলছে বিভূতিভূষণ তন্দ্রা জড়ানো গলায় পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, ‘ তোরা বড বকর বকর করিস, ঘুমোতে দে’
তাও মাঝরাত্তিরে জামকাপড়ের ভবিষ্যৎ কী হবে সে নিয়ে আলোচনাটা চলতেই থাকল।
মাঝরাত্তিরে ঘুমের মাঝে গলার হইহল্লায় বিরক্ত বিভূতি বললেন, ‘ তোরা শহরে থেকে থেকে অমানুষ হয়ে গেছিস, ওটা ইঁদুরের নয়, কাঁকড়া’।
গোটা হলঘর হইঘই করে উঠল! ‘বিছে নয় তো?’
এবার উঠে বসলেন। বালিশের তলা থেকে টর্চখানা বের করে বললেন, ‘শহরে থেকে থেকে তোদের আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না।কাঁকড়াবিছের আবার ওরকম খড়খড় আওয়াজ হয় নাকি? ওটা কাঁকড়ার ঝোলের কাঁকড়া।’
হলে গুদাম করে রাখা বস্তার গায়ে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল ভিতরের জীবগুলো খড়খড় করে নড়ছে।
খড়খড়ানির শব্দ কেন আসছে সে রহস্য ভেদ হতে বেশ নিশ্চিন্তি নেমে এল ঘরের ভিতর। কেবল একজন গোয়েন্দা কৌতুহলে প্রশ্ন করলেন, ‘ এক বস্তা কাঁকড়া কেন বিভূতিদা, তাছাড়া,আমাদের শোবার ঘরেই বা কেন এনে রাখল?
ঘুমধরা গলার উত্তর কানে এল, ‘ সারারাত ধরে আমাদের জানান দিতে যে আমাদের জন্য কাঁকড়া সংগ্রহ করা হয়েছে’
এক বস্তা কাঁকড়া কেন?
পরের দিন দুপুরে রান্না করা হবে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক তুলে দেওয়া হবে কলকাতার ট্রেনে।
সে রোববারের দুপুরে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’- এর কাহিনীকার দেখিয়েছিলেন কাঁকড়া খাওয়া কাকে বলে! একেবারে তাক লাগানো ব্যাপার।
পাত সাজিয়ে ভাত আর নানারকম ভাজাভুজি। পাশে বড় জামবাটির এক বাটি লাল টকটকে কাঁকড়ার ঝোল। বাটি দেখেই ঝলমলে হয়ে উঠল তাঁর মুখখানা। তরিতরকারী সব একধারে সরিয়ে রেখে কাছে টেনে নিলেন বাটিটা।
কিছুক্ষণের মধেই সে বাটি খালি। ফের টইটুম্বুর করে দিলেন গৃহকর্তী।
বাটি থেকে বিভূতিভূষণ একটা-একটা করে কাঁকড়া তুলছেন। দাঁড়াটা মড়মড় করে ভেঙ্গে চুষিকাঠির মতো চুষে নিয়ে দাঁত দিয়ে টুক করে কামড় দিয়ে ভেতরের শাঁস কুরে কুরে খেতে ব্যস্ত। কোও দিকে তাকাবার অবসর তাঁর নেই।
বাকিদের খাওয়া শেষ। কিন্তু তারা উঠতে পারছে না। দলপতির খাওয়া দেখছেন। খাওয়া তো নয়, যেন আর্ট।
একইভাবে ভর্তি হল বাটি। ফের খালি। তিন-তিনবার।
এবার পাত থেকে ওঠার অনুমতী চাইলেন সঙ্গী-সাথীরা। তিনি তাঁদের বললেন, ‘ তোরা ওঠ। আমার একটু দেরীই হবে। ভালো জিনিস রেখে-চেখে না খেলে আমি তৃপ্তি পাইনে’।
তাঁরা উঠেই পড়লেন। তবে রহস্য কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। রান্না না হওয়া আধবস্তা কাঁকড়া আদৌ ট্রেনে উঠেছিল কিনা, ধাঁধাটা কাটেনি।
বিভূতিভূষণের সঙ্গে তাঁর সঙ্গীসাথীদের দেখা হয়েছিল ফের দু’মাস পর।
সেদিনের কাঁকড়া খাবার বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে জানা গিয়েছিল, মেদিনীপুর থেকে ফেরার পর নাকি তিনদিন উঠতে পারেননি বিছানা থেকে।
তবে তাঁর দোষ নেই। সব দোষ নাকি ধান ক্ষেতের কাঁকড়ার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...