'পাঁচু? সে আবার কে?'
'আরে মশাই, পাঁচুকে চেনেন না!'
'না...।'
'তাহলে তো আপনাকে গোড়া থেকেই বলতে হয়। শুনুন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো বিএ পাশ করার পর পরই স্কুল মাস্টারি পেয়ে গেলেন। পেলেন ডায়মন্ডহারবারের এক গন্ডগ্রামে। সেখানে গিয়ে তাঁর আলাপ হল পাঁচুর সঙ্গে। 'পাঁচু' মানে, পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী। সে কবিমানুষ, বয়সে সদ্য যুবক। গ্রামের পত্রিকায় তার কবিতা বেরিয়েছে, লোকেরা তাকে একখানা খেতাবও দিয়েছে, 'বালক কবি'। রবীন্দ্রনাথের 'পোস্টমাস্টার' গল্পে পোস্টমাস্টার যেমন নিঃসঙ্গ পল্লীপ্রবাসে ছোট্ট রতনকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন, বিভূতিভূষণ তেমন করে গেলেন পাঁচুকে। ছেলেটি স্বভাবে সহজ-সরল, তার ওপর প্রকৃতি-প্রেমিক। সাহিত্যবোধও যথেষ্ট আছে। পাঁচুর এই গুণগুলোই বিভূতিভূষণকে টানল। এবং, এর ফলে পাঁচু অচিরেই তাঁর বন্ধু হয়ে গেল। বন্ধু যখন হল, তখন কে ভেবেছিল এই পাঁচুই প্যাঁচাল পাকিয়ে সাদাসিধে স্কুল মাস্টার বিভূতিভূষণকে সাহিত্যিক হতে বাধ্য করবে! তা, সে ব্যাপারটা কেমন করে ঘটল, সেটাই এবার বলি...
গত শতকের দুইয়ের দশক। কলকাতা থেকে ছ'আনায় একটি বই সিরিজে প্রতি মাসে বই বেরুতে শুরু করেছে। সবই হয় উপন্যাস, নয় গল্পের বই। পাঁচুর খুব ইচ্ছে সেও এরকম বই বার করবে, এক টাকায় একটা গ্রন্থাবলী। আর এই ব্যবসায় পার্টনার হতে হবে বিভূতিভূষণকে। ছোকরার ভাবনার ছিরি দেখে বিভূতি তো পড়লেন আকাশ থেকে। ব্যবসা যে করবেন, তা বই ব্যবসার তিনি জানেনটা কী! আর তাছাড়া লেখককে তো কিছু সাম্মানিক দিতে হবে, তার টাকাই বা আসবে কোত্থেকে? বই ছাপালেই তো হবে না, বিক্রিও তো করতে হবে। গন্ডগাঁয়ে বসে সে আবার হয় নাকি! কিনবে কে? টাকার সমস্যাটার একটা সমাধান পাঁচু ধাঁ করে সেরে ফেলল বইগুলো যদি পালা করে পাঁচু আর বিভূতিভূষণ লেখেন তাহলে তো আর লেখককে টাকা দেবার কথা ভাবতে হয় না। যদিও পাঁচু কবি, গল্প সে লেখেনা, তবু চেষ্টা করলে কী আর খান কয়েক লিখতে পারবে না? পারবে, খুব পারবে। আর বিভূতিভূষণ বিএ পাশ লোক, তাঁর তো এমনিতেই লিখতে পারা উচিত। বিভূতিভূষণ ভেবে পেলেন না বিএ পাশের সঙ্গে সাহিত্যরচনার আবশ্যিক শর্তটা কোথায়! যাঁরা বিএ পাশ করেন তাঁরা সকলেই কি সাহিত্যিক? যাক গে, তাঁর স্নেহের পাঁচু নেহাতই ছেলেমানুষ, কাজেই তার ভাবনাটিও বিলক্ষণ ছেলেমানুষি। ফলে, ব্যাপারটা ক্ষমাঘেন্নার কোটায় ফেলে বিভূতি বেমালুম ভুলে গেলেন। ভবীর মতোই পাঁচু কিন্তু ভুলল না।
বেশ কিছুদিন পর স্টেশনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখ গেল পাশের দেওয়ালে। অমনি বিভূতিভূষণের চক্ষু হল চড়কগাছ! বুঝলেন এ কম্ম নির্ঘাত পাঁচুর! কিন্তু, এ কী করেছে পাঁচু! ব্যাটাচ্ছেলে শুধু সেই দেওয়ালেই নয়, পাশের দেওয়াল, তার পাশের দেওয়াল এমনকি গাছের গায়ে অব্দি হ্যান্ডবিল সেঁটে দিয়েছে! আর তাতে কি লেখা জানেন? তাতে লেখা, নতুন একটি বইয়ের রোমহর্ষক বিজ্ঞাপন, আর সেই বইয়ের লেখক হলেন, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়! ব্যাটা করেছে কি! মানসম্মান সব ডোবাল দেখছি!
হ্যান্ডবিল থেকেই হল উৎপাতের সূত্রপাত। গাঁয়ের ছেলেবুড়ো-স্কুলের সহশিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা সবাই জেনে গেল যে, মাস্টারমশাই বই লিখবেন। জেনে সবাই এমন উৎসাহিত হয়ে উঠল যে, এদিন থেকেই তারা জ্বালিয়ে মারতে শুরু করল বিভূতিভূষণকে: 'কবে বেরুবে আপনার বই মাস্টারমশাই? বেরুলে আমাদের পড়তে দিতে হবে কিন্তু! ছাপার আগেই একদিন পড়ে শোনান না!' তাদের সঙ্গে মুখোমুখি হলেই হরদম এমন প্রশ্ন, এমন আব্দার। কিন্তু, লেখা কোথায়, যে পড়ে শোনাবেন, ছাপা হবে? বিভূতিভূষণের এমন অবস্থা যে, গিলতেও পারেন না, ওগরাতেও পারেন না! বলতে পারেন না যে, প্যাঁচালটা পাকিয়েছে পাঁচু, তাঁর কোন দায় নেই। আবার লোকের কাছে ঢপ দেওয়াও তাঁর স্বভাবে নেই। ফলে, হাঁপিয়ে উঠে শেষমেশ পাঁচুকেই চেপে ধরলেন, 'ওরে হতচ্ছাড়া করেছিস কী!' পাঁচু নিষ্পাপ হাসে, 'কেন, সেদিন কথা হয়ে গেল যে! আপনি-আমি লিখব, আমরা ছাপাবো। আমি তো কবি, আমার তো গল্পটল্প তেমন আসে না, তাই আমার ইচ্ছে, প্রথম বইটা আপনিই লিখবেন। সেজন্যই বিজ্ঞাপন দিয়েছি। আগে থেকে বিজ্ঞাপন না-দিলে চলে! বিক্রি করতে হবে না? ব্যবসা কী আর এমনি এমনি হয়!', এইরকম সরল স্বীকারোক্তির ওপর আর কিছুই বলা যায় না; অন্তত বিভূতিভূষণ কিছু বলতে পারলেন না।
বিভূতিভূষণের মাথায় ঘুরতে লাগল এখন একটাই চিন্তা : পাঁচু যে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, তা থেকে সম্মান বাঁচাতে তাঁর কাছে একটাই পথ খোলা খাতায় কিছুমিছু একটা লিখে ফেলা। বই ছাপা যে পাঁচুর দুরাশা, এ তিনি ভালোই জানেন। তবু লোককে অন্তত খাতাটা দেখিয়ে বলতে পারবেন, 'এই দেখ ভাই লেখা, ছাপা না-হলে আমি কি করবো!' এইসব সাতপাঁচ ভেবে তাঁর রোখটা চেপেই গেল লেখার। কিন্তু, কী লিখবেন? কলেজ ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ কবিতা লিখেছেন বটে, কিন্তু, সে আর এ তো এক নয়। কোনদিন ভাবেনইনি যে, সাহিত্যের জন্য একদিন কলম ধরবেন! তাহলে, এখন উপায়?
কয়েক রাত বিভূতিভূষণের ঘুম হল না, দিনেও শান্তি পেলেন না। প্লট ভাঁজার অভ্যেস নেই, তাই কিছুতেই স্থির করতে পারলেন না, কী লিখবেন, কাকে নিয়ে লিখবেন! অতৃপ্তি-অশান্তির এই আবহেই হঠাৎ একদিন ভেসে এলো একটা মুখ। নারীর মুখ। তিনি উপেক্ষিত এক মাতৃময়ী নারী। স্কুলে যাবার পথে বিভূতিভূষণ তাঁকে প্রায়ই দেখেন পুকুর থেকে কলসি কাঁখে জল আনতে। কথা হয় না, কিন্তু, তাঁর চোখে সংসারের উপেক্ষা-অবহেলা-বঞ্চনার কথা পড়তে জানলেই পড়া যায়। সেই নারীকে নিয়েই বিভূতিভূষণ লিখলেন তাঁর জীবনের প্রথম গল্প, 'উপেক্ষিতা'।
গল্পটা লিখে নিজেরই মনে হল, মন্দ হয়নি। এবার চাই বন্ধুদের মতামত। শুনে কেউ বলল, ভালো। কেউ বলল, মন্দ নয়। অন্তত খারাপ কেউ বলল না। তখন পাঁচুর মতো বিভূতিভূষণের বাসনা হল ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার, মনে হল, দেখাই যাক না পত্রিকার দপ্তরে জমা দিয়ে, ছাপে কি না।
কয়েক মাসের উদগ্রীব অপেক্ষার পর দেখা গেল, পত্রিকা সত্যিই গল্পটি ছাপল। ছাপার অক্ষরে নিজের সৃষ্টি সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পেরে বিভূতিভূষণের বুক যেন ভরে গেল। ব্যস, এটাই প্রেরণা হয়ে সেই যে শুরু হল, তাঁর কলম আর থামল না। 'পথের পাঁচালী', 'আরণ্যক', 'অপরাজিত'-র মতো অনবদ্য সাহিত্য উপহার দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেন। দিলেন প্রকৃতির সঙ্গে আত্মাকে খুঁজে নেওয়ার যায়--এমন এক নতুন পথের সন্ধান। পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী নিজেকে কবি হিসেবে হয়তো প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি কোনদিন, কিন্তু, বিভূতিভূষণকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন সাহিত্যের পথে। পাঁচু না-থাকলে আমরা হয়তো একজন আদর্শ শিক্ষককে পেতাম, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণকে পেতাম না। হয়তো।
তথ্যঋণ: 'আমার লেখা' - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।