তিনি লিখেছিলেন, ‘রঙের খনি যেখানে দেখেছি, রাঙিয়ে নিয়েছি মন’
জন্ম থেকেই আমি যাযাবর। আমার কোথাও ঘর নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই। আমার ভাগ্যে এক অবাক জীবনের খোঁজ লেখা আছে। সেভাবেই কেটে যাবে এক জীবন।
যাযাবর মনের এই মানুষটিকে গুণমুগ্ধদের কাছে ছিলেন ‘উপমহাদেশের পল রবসন’। পোশাকী নাম ভূপেন হাজারিকা। তিনি শুধু এক নাম নন, তিনি াসলে একটি যুগ। যিনি ধারণ করেছিলেন এদেশের গণসঙ্গীতের ইতিহাসের এক ধারাকে।
জন্ম ১৯২৬ এর ৮ সেপ্টেম্বর। অসমের তিনসুকিয়া জেলায়। ভারত-মায়ানমার সীমান্তের পাশের এক ছোট্ট শহর সাদিয়ায় থাকতেন।
বাবা নীলকান্ত হাজারিকা প্রথম জীবনে ছিলেন স্কুল শিক্ষক। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বাঁধনহীন মুক্ত শৈশব পেয়েছিলেন। নদীর ধার ধরে ছুটে বেড়াতেন। জলের মাঝে জল ছিটিয়ে খেলা। জল ছুঁয়ে ছুঁয়েই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। জল আর তাঁর মধ্যে কোনও বাধা ছিল না। নদী জল তাঁকে টানত।
১৯৫০ সনের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র বাঁক বদল করেছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। তলিয়ে গিয়েছিল পিতৃপুরুষের বসতখানা। ভাগ্যের এমন পরিহাস, যে নদী তাঁর মা, যাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতেন সেই নদীই গ্রাস করেছিল জন্মস্থান এবং পূর্বপুরুষের শেষ স্মৃতিচিহ্নটাও। মুহুর্তে উপড়ে গিয়েছিল শিকড়। কিন্তু মন থেকে মাটির টান ধ্বংস করতে পারেনি। যত দিন গিয়েছে তা ছড়িয়েছে মাটি থেকে মানুষে। মানুষের গান গাইতেন। তাঁর গানে মানুষে-মানুষে কোনও কাঁটাতাঁর নেই। হাসি- কান্নার কোনও সীমান্ত হয় না।
তাই গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ভলগা, মিসিসিপি সব একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর গানে। নিজের ঘর ভেঙে গিয়েছিল ভাঙনে। আরও বড় ঘর পেয়েছিলেন তিনি। বিশ্বঘরকে আপন করেছিলেন। গোটা পৃথিবীটা তাঁর নিজের জন।
বাবা রেভেনিউ দফতরে যখন চাকরি নিলেন তখন থেকেই কার্যত শুরু হয়েছিল যাযাবর জীবন। এক ভূম থেকে আর এক ভূমে পাড়ি। তাঁর প্রথম পোস্তিং ধুবড়ি। বাবা-মার প্রথম সন্তান ভূপেন তখন সবে যৌবনে পা রেখেছেন আলাপ হল এক রাজপুত্রের সঙ্গে। তিনি শুধু ত্রিপুরার রাজকুমার নন, রূপালী পর্দার রাজকুমারও। প্রমথেশ বড়ুয়া। কানন দেবীর বিপরীতে ‘মুক্তি’ ছবির শুটিং চলছিল সেই সময়।
খামখেয়ালী প্রমথেশের কীভাবে যেন ভালো লেগে গিয়েছিল উদাস মনের সদ্যযুবাকে। দু’জনের সঙ্গ আজীবন বজায় ছিল। গান থেকে ছবি হয়ে একই মাটির টান প্রমথেশ- ভূপেন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল নদীর স্রোতের গতিতেই।
বহুবছর পর নিজের ছবি ‘মাহুত বন্ধু রে’ ছবি করতে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন ধুবড়িতেই।এখান থেকেই শুরু হয়েছিল শুটিং। এই ঘটনা আপাতভাবে কাকতালীয় মনে হলেও এ আসলে স্মৃতির টান।
ধুবড়ি বাঙালি ও অসমিয়া সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র। এই জেলা নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছিল ভূপন হাজারিকার জীবনকে।ভাটিয়ালী সুর মিশেছিল তাঁর সত্ত্বায়।
১৯৩৫-এ বাবা ফের বদলি হলেন তেজপুরে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কেটেছিল এখানেই। অসম সংস্কৃতি, গান, থিয়েটার এবং গণ-আন্দোলনের প্রধানকেন্দ্র। হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরেই সংগীতে পথচলা শুরু হয় ভূপেনের। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদ প্রভাবিত করেছিলেন ভূপেনকে।
জল, মাটি, মানুষ- এই তিন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে তাঁর পৃথিবী। ব্যারিটোন ভয়েসের আড়াল ভেঙে মায়ের মায়া। হাহাকার নিংড়ে আসত যখন তিনি গেয়ে উঠতেন,
“বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-
হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-
গঙ্গা বইছ কেন?”
রুদালী কন্যার কণ্ঠ তাঁর সুরে গেয়ে চলে,
“দিল হুমহুম করে ঘাবড়ায়ে,
ঘন ধাম ধাম করে ডর জায়ে”
মরুভূমির উষর প্রান্তে এক ফোঁটা জলের জন্য কান্নায় কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে নদীর করুন সুর। সব হারাদের অসহায় দীর্ঘশ্বাস।
অসমের যাযাবর মানুষটি এভাবেই তাঁর সাকিন খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের মনের বসতে...