কল্লোল যুগের অন্যতম সাহিত্য-স্রষ্টা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের জন্মবার্ষিকী

১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ আজকের দিনেই বাংলার নোয়াখালিতে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। ৭৩ বছরের জীবনে তিনি রেখে গেছেন একাধিক উপন্যাস সহ ছোটো গল্প, জীবনী ও কবিতার অনন্য সম্ভার। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পর সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কল্লোল যুগের লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

বাড়ি মাদারিপুর জেলায় হলেও বাবা রাজকুমার সেনগুপ্ত কর্মসূত্রে নোয়াখালি চলে এলে সেখানেই কাটে তাঁর শৈশব, বর্তমানে নোয়াখালির অবস্থান বাংলাদেশে। ১৯১৬-য় বাবার মৃত্যু হলে দাদা জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে থাকতে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। ১৯২০তে কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনের পাঠ চুকিয়ে ১৯২২-এ ইন্টারমেডিয়েট পড়তে সাউথ সাবার্বান কলেজে ভর্তি হন, যা পরে টআশুতোষ কলেজট নামাঙ্কিত হয়। ক্রমে ১৯২৪-এ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বি.এ ও ১৯২৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ সম্পন্ন করেন।  ১৯৩১ সালে তিনি অস্থায়ী মুন্সেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ক্রমে সাব-জজ, জেলা জজ ও ল' কমিশনের স্পেশাল অফিসার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৬০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯২১-এ প্রবাসী পত্রিকায় নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে অচিন্ত্যর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কল্লোল এর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকায় সেই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবে উঠে আসে তাঁর নাম। মূলত রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ফিকশনধর্মী টেক্সট লেখার জন্য তিনি এখনও স্মৃতির অতলে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। লিখনশৈলী ছিল প্রবলভাবে আধুনিকতায় সমৃদ্ধ। ১৯২৮ সালে প্রথম উপন্যাস ‘বেদে’ প্রকাশিত হলে আঙ্গিক, কাব্যশৈলী ও বিষয়বিন্যাসে তা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে অনায়াসে জায়গা করে নেয় ১৯৩১ এ প্রকাশিত ‘কাকজ্যোতস্না’‘বিবাহের চেয়ে বড়’ উপন্যাস দুটি। কবিতার অ্যানাটমি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মূল বিষয়গুলির মধ্যে রোম্যান্টিসিজম্‌-এর পাশাপাশি বিপুলভাবে গণচেতনার আবহ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। শ্রমিকশ্রেণীর জীবন সংগ্রামের ছায়া বারবার ধরা দিয়েছে তাঁর লেখনীতে। উপন্যাস ছাড়াও যে সব কবিতা তিনি লিখেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যতা বহন করে ‘অমাবস্যা’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘আজন্মসুরভী’ ও ‘উত্তরায়ণ’-এর মতো কাব্যগ্রন্থগুলি।

ওরা কারা চলেছে আমাদের আগে-আগে-ওরা কারা?
ওরাও উদ্বাস্তু।
কত ওরা জেল খেটেছে তকলি কেটেছে
হত্যে দিয়েছে সত্যের দুয়ারে,
কত ওরা মারের পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়েছে
পেরিয়ে গিয়েছে কত কষ্টক্লেশের সমুদ্র,
তারপর পথে-পথে কত ওরা মিছিল করেছে
সকলের সমান হয়ে,
 কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে,
পায়ে-পায়ে রক্ত ঝরিয়ে-
কিন্তু ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদে এসে
ছেঁড়াখোঁড়া খুবলে-নেওয়া মানচিত্রে
 
যেন হঠাৎ দেখতে পেল আলো-ঝলমল ইন্দ্রপুরীর ইশারা,
ছুটল দিশেহারা হয়ে
এত দিনের পরিশ্রমের বেতন নিতে
মসনদে গদীয়ান হয়ে বসতে
ঠেস দিতে বিস্ফারিত উপশমের তাকিয়ায়।

পথের কুশকন্টককে যারা একদিন গ্রাহ্যের মধ্যেও আনেনি
আজ দেখছে সে-পথে লাল শালু পাতা হয়েছে কিনা,
ড্রয়িংরুমে পা রাখবার জন্যে আছে কিনা
বিঘৎ-পুরু ভেলভেটের কার্পেট।
ত্যাগব্রতের যাবজ্জীবন উদাহরণ হয়ে থাকবে ব'লে
যারা এত দিন ট্রেনের থার্ড ক্লাসে চড়েছে
সাধারণ মানুষের দুঃখদৈন্যের শরিক হয়ে
তারাই চলেছে এখন রকমারি তাকমার চোপদার সাজানো
দশঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে
পথচারীদের হটিয়ে দিয়ে,
 তফাৎ ক'রে দিয়ে
সমস্ত সামনেওয়ালাকে পিছনে ফেলে
পর-ঘর বিদেশী বানিয়ে।
হ্যাঁ,
 ওরাও উদ্বাস্তু।
কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
 
কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে।

   (উদ্বাস্তু কবিতার একটি অংশ)

ছোটোগল্প লিখেও অর্জন করে নিয়েছিলেন পাঠককূলের সুখ্যাতি। ‘টুটা-ফুটা’, ‘অধিবাস’, ‘কাঠ খড় কেরোসিন’, ‘হাড়ি মুচি ডোম’ ও ‘চাষাভূষা’র মতো গল্পগ্রন্থগুলি এখনও একইভাবে বাংলার লোকজীবন’কে তুলে ধরে ইতিহাসের পটচিত্রে। ১৯২৫-এ কল্লোল পত্রিকা সম্পাদনার যাবতীয় দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং অচিরেই পরিণত হন কল্লোল যুগের অন্যতম স্রষ্টায়। কিছুদিনের জন্য বিচিত্রা পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন।  

গল্প, কবিতা, উপন্যাস ছাড়াও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মতো দ্রষ্টার জীবনী রচিত হয়েছে তাঁর কলমে। চার খন্ডে ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’ (১৯৫২-৫৭), তিন খন্ডে ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’ (১৯৫৮-৬৯) ছাড়াও ‘উদ্যত খড়্গ’, ‘অখন্ড অমিয় শ্রী গৌরাঙ্গ’-এর মতো বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ প্রাণ পায় তাঁর কলমে। স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ হিসেবে দুটি গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেন। ‘কল্লোলযুগ’ (১৯৫০) ও ‘জৈষ্ঠ্যের ঝড়’; এগুলিকে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে ১০০টিরও অধিক বই রচনা করেছেন তিনি।

সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে জগৎতারিণী পুরষ্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরষ্কার ও শরৎচন্দ্রস্মৃতি পুরষ্কার অর্জন করেন অচিন্ত্যকুমার। তাঁর বেশ কিছু রচনা বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯শে জানুয়ারি কলকাতার বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ এত বছর পরেও তাঁর চিন্তাশীল রচনার জন্য একইভাবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...