তাঁর লেখা-লেখা খেলায় ঘুমিয়ে ছিল বিশ্বজয়ের বীজ

বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়ির লাইব্রেরীটা ছিল তাঁর সবচেয়ে কাছের। বাড়ির এই ঘরটাতে পা দিলে ভুলে যেতেন নাওয়া-খাওয়া। সামাজিক অনুশাসনে স্কুল গিয়ে পড়াশোনার ছাড়পত্র মেলেনি। বাড়ির লাইব্রেরী ঘরটাই খুলে দিয়েছিল পৃথিবীর দরজা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বুকের ভিতর কথা ঘনিয়ে ওঠে। মনের থেকে টান আসে। আপনি হাত চলে যায় কলম-খাতায়।

আত্মজীবনীতে নিজের লেখা শুরুর গল্প বলতে গিয়ে লিখেছেন, শুরু হল লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায় ভীষণ লজ্জায় সেই হিজিবিজি লেখা, ছড়া, গল্প।...কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সঙ্কুচিত হয়ে উঠি।”

লুকিয়ে লেখা কাব্যগুলোই একদিন বাংলার ঘরে ঘরে অজস্র পাঠকের কাছে পৌঁছে দিল লাইব্রেরি ঘরের সেই একলা মেয়েটাকে। পৃথিবী তাঁকে চিনেছিল সুফিয়া কামাল নামে।

১০ আষাঢ়, ১৩১৮ বঙ্গাব্দে বরিশালের শায়েস্তাবাদে নবাব পরিবারে তাঁর জন্য। সেদিন ছিল ‘পুণ্যাহ’ উৎসব।

মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন। বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী। নামকরা উকিল ছিলেন। কিন্তু সুফিয়ার সাত বছর বয়সেই বাবা গৃহত্যাগী হন।

সুফিয়ার বড় হয়ে ওঠা মামাবাড়িতে।  ভারী যত্নে, আদরে মা লালন করতেন ছোট্ট সুফিয়াকে। তিনি প্রথম বই হাতে তুলে দেন। সুফিয়ার মামা প্রতিদিন বাংলা বই পড়ে শোনাতেন।

তাঁর পরিবারে কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। তিনি নিজের চেষ্টায় বাংলাভাষা শেখেন।  মামাবাড়ির লাইব্রেরী ঘরখানা তাঁকে বড় টানত।

অভিজাত পরিবারের পড়াশোনার মুক্ত পরিবেশ থাকলেও সামাজিক অনুশাসনের বাইরে পা রাখা সম্ভব ছিল না। তাই  ঘেরাটোপের বাইরে এসে দাদা-ভাইদের সঙ্গে ছেলেদের বেশে স্কুল যাওয়া শুরু করলেও তা বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা।

বাড়িতেই অঙ্ক, ইংরাজির পাঠ নিতে শুরু করলেন। সঙ্গে বাংলা।

সন্দেশের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। কিন্তু কোনও পত্রিকাই তাঁর নামে আসত না।  সে সময় সমাজে মেয়েদের লেখা পড়ার চল ছিল না। তাই লোকচক্ষু থেকে বাঁচতে পত্র-পত্রিকা আসত বেনামে।

বয়স যখন বছর সাতেক তখন কলকাতায় বেড়াতে এসে দেখা করলেন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতের সঙ্গে।  সেই সাক্ষাৎ আমূল বদলে দেয় তাঁর জীবনের গতিপথকে। সুফিয়াকে তিনি ডাকতেন ‘ফুলকবি’ বলে।   

সাহিত্যপত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলে ডুবে থাকতেন। সেই সময়ের মহিলা কবিদের লেখা পড়তেন। পড়তে পড়তে লেখা এসে আপনি ধরা দিল কলমে।

১২ বছর বয়সে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হল প্রথম গল্প “সৈনিক বধূ”। “তরুণ” নামের একটি মাসিক পত্রিকায়।  ষোল বছর বয়সে প্রথম গল্পের বই “কেয়ার কাঁটা”

১৯২৪ সালে আবার বদলে গেল সুফিয়ার জীবন।তখন সবে তেরো ছুঁয়েছে, বিয়ে হল নেহাল হোসেনের সঙ্গে। তরুণ ছাত্র, সাহিত্যিক, আবার সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিতি আছে।  সুফিয়ার পড়াশোনায় বিশেষ করে সাহিত্যে আগ্রহ দেখে নেহাল তাঁকে সব রকম ভাবে উৎসাহ দিয়ে যান। জীবন সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে লাগল। লিখতে শুরু করলেন।কলকাতায় বসবাসকালে যোগাযোগ হল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লীলা রায়ের সঙ্গে। কিন্তু ১৯৩২ সালে স্বামীর অকাল মৃত্যু বদলে দিল জীবনকে।

সুফিয়া কামাল কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। কর্মক্ষেত্রে পরিচয় হল জসিমউদ্দিনের সঙ্গে।

পরবর্তী সময়ে বদলে গিয়েছিল সুফিয়া কামালের লেখার গতিমুখ। অন্য ভাষা, অন্য দেখা প্রভাব ফেলছিল লেখনিতেও। সেই বদলের নেপথ্যে এক দামাল কবি।কাজী নজরুল ইসলাম সুফিয়ার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

sufia1

 ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশিত হল। গ্রন্থের প্রস্তাবনা লিখে দিয়েছিলেন কাজী সাহেব। রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন নবীন লেখিকার লেখনীর। আশীর্বাণী পাঠালেন তাঁকে।

১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তার নামে কামাল যোগ হয়ে সুফিয়া কামাল নাম হয়। 

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং সত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সুফিয়া কামালের সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তিনি শুধু একা নন, তাঁর সন্তানরাও নানাভাবে যুক্ত ছিলেন।

  তিনি নিজে ছিলেন ধীরস্থির। শান্ত। কিন্তু উথালপাতাল ঢেউ বারবার আছড়ে পড়েছে জীবনে। লড়াইটা শুধু ব্যক্তিগততে আটকে রাখেননি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সময় যখনই অশান্ত হয়েছে তখনই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের সংগঠনের কাজে দেখা গিয়েছে তাঁকে। মুক্তি-আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য করেছেন।

১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুঃস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানটের মতো বহু কর্মকান্ডে জড়িয়ে ছিলেন তিনি।

sufia

বহু সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু নিজের আদর্শের পথ থেকে কখনও সরেননি। তাই ১৯৬৯ তে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সরকারের জনবিরোধী কাজের প্রতিবাদে।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি মারা যান। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান পান।

শুধু মাত্র সাহিত্যের পরিসরে তাঁর ব্যাপ্তিকে মাপা যায় না। কলমে তো বটেই সামগ্রিক চিন্তা- চেতনায় তিনি যোদ্ধা। ভাষা এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...