ঘর-সংসারের আলোয় বাসন্তী দেবী

বাসন্তী দেবী। তিনি একাধারে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সংগ্রামী। সংগ্রামের জন্য কারাবরণ করেছেন। অন্দর ছেড়ে অবগুন্ঠণ ছেড়ে উপনিষদের বিদুষীদের মতো পুরুষের সমকক্ষ হয়ে সহকর্মী হয়ে দেশমুক্তির সাধনা করে গেছেন। তাঁর সেই অকুতোভয় সংগ্রামী রূপটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত, তার বাইরে তাঁর ঘরোয়া, স্নিগ্ধ ও বুদ্ধিদীপ্ত মনটির খবর অনেকেই হয়তো রাখেন না।

বাসন্তী দেবী মন ও মানসিকতায় পৌরাণিক সতীনারীদের চারিত্রিক মহত্বটি যেমন অনুকরণীয় মনে করতেন; তেমনি গার্গী, মৈত্রেয়ীদের মতো চারিত্রিক দৃঢ়তায় বুদ্ধি দিয়ে আপন যুক্তি তুলে ধরার ক্ষমতাও রাখতেন। এ-দুইয়ের মেলবন্ধনে তিনি অনন্যা।

স্বামী চিত্তরঞ্জন অবশ্য বৈদিক হিন্দুত্ব অনুসরণ করতেন। তাই জাতিভেদ মানতেন না। সমাজে ব্রাহ্মণই যে শ্রেষ্ঠ এ-কথাও মানতেন না। একদা তাই নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও বড় মেয়েকে কায়েতের বাড়িতে বিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। জাতপাত-সর্বস্ব সেই যুগে তাই নিয়ে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। উঠল ‘গেল গেল’ রব।

চিত্তরঞ্জন স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি সমাজের কথায় কর্ণপাত করলেন না। উপরন্তু বিয়েতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বাদ দিয়ে অন্য কোন জাতের বড় কোন পণ্ডিতকে দিয়ে বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন করাতে চাইলেন।

আপন এই চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে এক রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি পত্নী বাসন্তীর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। তাতে ক্ষণেই দু’জনের মধ্যে মতের অমিল ঘটল। কেননা, প্রচলিত হিন্দুরীতির প্রতি বাসন্তী দেবীর অমোঘ একটা টান রয়েছে। তাই তিনি ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পৌরহিত্যেই বিবাহ অনুষ্ঠান করতে চাইলেন। কাজেই তর্ক বাঁধল। চলল অনেকক্ষণ। কিন্তু নিষ্পন্ন হল না। চিত্তরঞ্জনই শেষমেশ চুপ করলেন। তারপর সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। বাসন্তীও চলে গেলেন নিজের হেঁশেল গোছানোর কাজে।

 

Basanti1

 

রাত্তির হল। গুছিয়ে-গাছিয়ে বাসন্তী ঘরে এলেন। দেখলেন, চিত্তরঞ্জন তখনও ঘরে আসেননি। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। মনে তৈরি হল উদ্বেগ। তিনি খুঁজতে খুঁজতে কোথাও না-পেয়ে অবশেষে ওপরে এলেন। ছাদে উঠলেন। দেখলেন, অস্থির হয়ে চিত্তরঞ্জন ছাদে পায়চারি করছেন। যাক। তাই দেখে অশান্ত হৃদয় তাঁর শান্ত হল। কাছে গেলেন। বুঝলেন, চিত্তরঞ্জন অস্থির, পায়চারি করছেন এবং সেই সঙ্গে অবরুদ্ধ আবেগে কাঁদছেনও।

বাসন্তী অতি ধীরে শান্ত স্পর্শে চিত্তরঞ্জনকে স্থির করলেন। চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। বললেন, অস্থির হয়ো না। একটু বুঝে দেখো, তুমি তো সমাজের সংস্কার করতে চাইছ, অন্যের কাছে সংস্কারের আদর্শ তুলে ধরতে চাইছ। এবার তুমি যদি একসঙ্গে সমস্ত রীতিনীতি ওলটপালট করো, সাধারণ মানুষ তা কি একেবারে গ্রহণ করতে পারবে? পারবে না। তাই একটু একটু করে সংস্কার করো। তারাও একটু একটু গ্রহণ করবে। জাতিভেদ না-মেনে কায়েতের ঘরে মেয়ে দিচ্ছ, আমি বাধা দিইনি। তবে ব্রাহ্মণ পুরোহিতটুকু রেখো। তাহলে লোকে তোমার জাতিভেদ না-মানার আদর্শটুকু অনুসরণ করতে পারবে। পরেরটা পরে।

কথা শেষ করে বাসন্তী স্বামীর মুখপানে চেয়ে রইলেন। চিত্তরঞ্জন তখন দূরে দৃষ্টি রেখে তাঁর কথাগুলোই ভাবছিলেন। ভাবনা শেষ হতেই হঠাৎ যেন সিদ্ধান্তে উপস্থিত হলেন তিনি। কারণ, মুখ উজ্জ্বল হল, মুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখারা বিদায় নিল, দৃষ্টি ফিরে এল বাসন্তীর মুখে। বললেন, ‘ওঃ, তুমি আমায় কি আলোই যে দেখালে!’

এই উচ্ছ্বাসের পর বিবাহে-আয়োজনে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশই রইল না। সমস্তই সুষ্ঠুভাবে সমাধা হল। বারে বারে চিত্তরঞ্জনের জীবনে এমন করেই শ্রদ্ধা ও মেধার নিবেদনে সংসার-সংগ্রামে-সংশয়ে তর্ক এবং উপদেশে পথ দেখিয়ে বাসন্তী হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত অর্ধাঙ্গিনী…

কাহিনি ঋণঃ চিত্তরঞ্জন- সুকুমাররঞ্জন দাশগুপ্ত।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...