রবিকাকার ‘বলু’

“আমার বলুকে আমি হারাইয়াও হারাই নাই, বরং তাহাকে আরও নিকট পাইয়াছি বলিয়া মনে হয়, এক সে আমার বহু হইয়া অহরহ আমার সম্মুখে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আজ সে অনন্তরূপে অনন্ত বাহু মেলিয়া আমার বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে”।

ছেলের স্মৃতিতে মায়ের এমন লেখা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ নেই। এক মাত্র সন্তানের অকালপ্রয়াণের শোককে কলমে ধারণ করা সহজ নয়। তবু তিনি লিখেছিলেন। ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে পর্দাসীনা অভিজাত বধূ সন্তানকে জাগিয়ে রেখেছিলেন এভাবেই।
প্রফুল্ল কুমারী দেবীর কলমে উঠে এসেছিল পুত্র বলেন্দ্রনাথের কথা।
আয়ু মাত্র ২৯ বসন্ত। কিন্তু সেই স্বল্প আয়ুতেই পেয়েছিলেন ধ্রুবতারার উজ্জ্বলতা। মননে, ব্যক্তিত্বে, মেধায়, কলমে সবেতেই তিনি নজর কেড়েছিলেন সমকালের।
বাবা বীরেন্দ্রনাথ। মহর্ষির চতুর্থপুত্র।মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। বহু চিকিৎসাতেও সুরাহা মেলেনি।
বীরেন্দ্রনাথের পুত্র বলেন্দ্রনাথ ওরফে বলু ছোটবেলা থেকেই দুর্বল। জন্ম থেকেই পায়ের সমস্যা। চলতে গেলে ঈষৎ টেনে চলতে হত। সে নিয়ে কম ব্যাঙ্গের মুখে পড়েননি। কিন্তু অদ্ভুত মনের জোর। বাবার দুর্বলতাই যেন বলেন্দ্রর জেদকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
মা প্রফুল্লদেবী লিখছেন,
‘যখন (সে) আট-নয় বছরের, সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে, সে লেখাপড়া শিখিয়া ইঞ্জিনিয়ার হইবে। লেখাপড়া তাহার নিকট একটা প্রিয় বস্তু ছিল, কোনোদিন তাহাতে অবহেলা করে নাই।
রবীন্দ্রনাথ এবং মৃণালিনী দেবী দুজনেই খুব ভালোবাসতেন আদরের ‘বলু’কে। বলেন্দ্রনাথ লেখালেখির ক্ষেত্রে অভিভাবক মানতেন কাকা রবীন্দ্রনাথকে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বলুদাদার যখনই কোনো প্রবন্ধ লেখা শেষ হত বাবাকে দেখাতে নিয়ে আসতেন। ভাব ও ভাষা দুদিক থেকেই তন্ন তন্ন করে বিচার করে বাবা তাঁকে বুঝিয়ে দিতেন কি করে বিষয়টি লিখতে হবে।“”

যতক্ষণ না লেখা সম্পূর্ণ মনের মতো হয়ে উঠছে ততক্ষণ চলতেই থাকত লেখার বিচার। চলত সংশোধনের পর্ব। একাধিকবার।
পনেরো-ষোল বছর বয়সেই ভাষার স্বাতন্ত্র্য আয়ত্ব করেছিলেন বলেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা শেখার গুরু হয়েও রবি ভাষার কোনও প্রভাব লেখায় পড়েনি।
প্রবন্ধ লিখতেন। লিখেছেন ভ্রমণ বৃত্তান্তও। পৃথিবীটাকে নেড়ে-ঘেঁটে দেখার অভিলাষ ছিল আজীবন। তিনি লেখা লিখতেন না, লেখা দেখতেন। শিল্পীর মগ্নতায় রং চাপাতেন শব্দে, অক্ষরে। গভীর অনুভবে কথা বলে উঠত তারা। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য তাঁর ভাষাকে করে তুলেছিল লিরিক্যাল। কবিতাও লিখেছিলেন। দু’খানি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।
বলেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘একরাত্রি’ নামে প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয় ‘বালক’ পত্রিকায়। ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। ওই বছর ফাল্গুন সংখ্যায় বেরোয় ‘সন্ধ্যা’ নামে কবিতা। বয়স তখন ১৫ বছর।
পরের বছর মাঘোৎসবে বলেন্দ্রনাথের লেখা গান প্রাতঃকালীন সভায় গীত হয়। জীবদ্দশায় তিনটি বই— "চিত্র ও কাব্য" (১৩০১, প্রবন্ধ), "মাধবিকা" (১৩০৩, কাব্য), "শ্রাবণী" (১৩০৪, কাব্য) প্রকাশিত হলেও তাঁর অধিকাংশ লেখা ছড়িয়ে ছিল "সাধনা", "ভারতী"-সহ নানা পত্রিকায়।
আর্যসমাজ আর ব্রাহ্ম সমাজকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন ভীষণভাবে। লেখা চর্চার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার দিকটিও দেখতেন তিনি। বিষয়গত ক্ষেত্রে তাঁর ওপর অনেকটাই নির্ভর করতেন রবিকাকা।
প্রচন্ড পরিশ্রম করতেন। ব্যবসা আর ব্রাহ্ম সময়ের কাজে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। সঙ্গে নিয়মিত লেখালেখি আর পড়াশোনা।
দুর্বল শরীর ভেঙে পড়তে লাগল কাজের ধকলে। বাড়ির লোক সতর্ক করে। কিন্তু কাজের টানে খেয়াল থাকে না সে কথা।

১৮৯৯-তে গেলেন শিলাইদহ। সঙ্গে রবিকাকা। কিন্তু পরিশ্রমের দাপটে শরীর আর বশ মানছে না যে। অসুস্থতা বাড়ায় ফিরতে হল। সব ধরনের চিকিৎসা শুরু হল। ডাক্তাররা সদা তৎপর। রোগশয্যায় মাথার পাশে সারাক্ষণ রবিকাকা।
যমে মানুষে লড়াই চলে প্রতিক্ষণ। প্রফুল্লময়ীকে অভয় দেন তাঁরা। ভরসা পান না মা।
শেষ পর্যন্ত একদিন সত্যি সত্যিই থেমে গেল লড়াইটা। সেদিনের স্মৃতি লিখেছেন প্রফুল্লময়ী, “যেদিন সে জন্মের মতো আমাকে তাহার বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া চলিয়া গেল, সেইদিন রবি (রবীন্দ্রনাথ) আসিয়া আমাকে বলিলেন যে, তুমি একবার তার কাছে যাও, সে তোমাকে মা-মা করিয়া ডাকিতেছে।আমি এক এক সময় তাহার যন্ত্রণা দেখিতে না পারিয়া পাশের ঘরে গিয়া থাকিতাম। রবির কথা শুনিয়া যখন তার কাছে গিয়া তার পাশে বসিলাম তখন তার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। মনে হইল আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল, তাহার পর একবার বমি করিয়া সব শেষ হইয়া গেল।”
বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয় ‘প্রদীপ’ পত্রিকায়। ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
বলেন্দ্রনাথের স্মৃতি বহুদিন যন্ত্রণায় রেখেছিল কবিজায়াকেও।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...