"আমি মমতা থেকে তুলে এনেছিলাম পরিহাস
আমি বিষাদ থেকে তুলে এনেছিলাম অশ্রু
আমি ঘুম থেকে তুলে এনেছিলাম স্বপ্ন
আমি স্মৃতি থেকে তুলে এনেছিলাম অভিমান
আমি শব্দ থেকে তুলে এনেছিলাম কবিতা"....
এই অসাধারণ কবিতা যে কবির লেখা তিনিই অবলীলায় লিখতে পারেন... "মদ খাওয়ার সময় আমি কোনো রিস্ক নিই না"র মতো মজারু রম্যরচনা। লেখেন...
.."উত্তরের অনন্ত বাতাসে ঝরা পাতার মতো উড়ে উড়ে পড়েছে
আমার পরিহাসময় অশ্রু, আমার স্বপ্নময় অভিমান"...
আবার তিনিই কত সহজে যে লিখতে পারেন "বিদ্যাবুদ্ধি", "কাণ্ডজ্ঞান" বা "জ্ঞানগম্যির" মতো হাস্যরসে টইটম্বুর বইগুলি!!
তিনি তারাপদ রায়। তাঁকে আমরা মূলতঃ চিনি তাঁর মজাদার লেখাগুলোর জন্য অথচ তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক একজন অত্যন্ত শক্তিশালী কবি।
"...এখন আর কোনোখানে যাওয়া নেই,
এখন কেবল ঠান্ডা বাতাস, এখন বৃষ্টি, জল
আমার চারপাশ ঘিরে পাতা ওড়ে আর জল পড়ে।
এখন তোমার জন্য দুঃখ হয়,
আমি নিজে ফিরে গিয়েছিলাম অথবা
তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, এখন দুঃখ হয় ।"
তাঁর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা বাংলাদেশের) টাঙ্গাইলে ১৯৩৬ সালের ১৭ই নভেম্বর। ওপার বাংলার বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৫১ -তে চলে আসেন কলকাতায়। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হন তিনি। প্রথম চাকরি শিক্ষকতার। পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকারি আধিকারিক হিসেবে নিযুক্ত হন।
নিজের মধ্যেই একটা আলাদা জীবনের বৃত্ত তৈরি করেছিলেন তারাপদ। সহজ, সাবলীল সেই ভাষা; তার মধ্যেও নিজস্ব দর্শন। লেখালিখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়েই। কবিতার সূত্রেই পরিচয় এবং বন্ধুত্ব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং সুনীল সূত্রেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় - এদের সঙ্গে - যারা "মধ্যরাত্রে কলকাতা শাসন" করতেন ষাটের দশকে।
তখন তারাপদ রায় থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের কাছে মহিম হালদার স্ট্রীটে। একদল তরুণ কবি জড়ো হতেন তাঁর বাসায়। তাঁদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন, হাতে কলম। তরুণ কবিদের স্বপ্নের নদীতে ভেসেছিলেন তিনিও। জন্ম হল কৃত্তিবাস পত্রিকার। তারাপদ রায় নিজেই ছিলেন এক "কৃত্তিবাসী"।
কৃত্তিবাস পত্রিকাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন কৃত্তিবাস।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তারাপদ রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শক্তি তারাপদ রায়কে ডাকতেন "টর্পেডো" বলে।
"দুটো বিড়াল। সুযোগ পেলেই তারা রাগী প্রতিবেশিনীর বাড়িতে গিয়ে চৌর্যবৃত্তি চালিয়ে মাছের টুকরা সরিয়ে ফেলে। তাদের একজনের নাম "বিন্দু" হলে আরেকজনের নাম কী হতে পারে?
তাদের প্রভু বা গৃহস্বামীকে মান বাঁচানোর জন্য বলতে হয় "বিশ্বাস করুন আমি এর বিন্দুবিসর্গ জানিনা"... অর্থাৎ কিনা দ্বিতীয় বাঘের মাসিটির নাম হল "বিসর্গ"। এই মজাদার নামকরণ বা লেখা কার হতে পারে তারাপদ রায় ছাড়া?
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর কবিতা চর্চার ফাঁকেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "তোমার প্রতিমা"। প্রথম কবিতার বইয়ের ভেতরেই থেকে যায় মুদ্রণের ত্রুটি। "মহিম হালদার স্ট্রিট"-এর "মহিম" এর বদলে ছাপা হয় ‘মহিষ’। যা নিয়ে পরে ঠাট্টা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু এসবের মধ্যে দিয়েই একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল তাঁর কবিতা।
বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন তিনি। ছোটদের জন্যও লিখেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল "ডোডো তাতাই" যা এখনও জনপ্রিয়।
২০০৭ এর ২৫শে আগস্ট মৃত্যু হয় এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকের।
তারাপদ রায়ের কবিতা দিয়েই এই নিবন্ধ শুরু, কবিতা দিয়েই শেষ হোক...
...অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
"অনেকদিন দেখা হয় নি"।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
(একজন্ম–তারাপদ রায়)