"তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ, তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত তার মানে তুমি একজন ভালো মানুষ"...
এই উক্তিটি যার তিনি একজন যাদুকর। কিন্তু তিনি মঞ্চের যাদুকর নন, তিনি কলমের যাদুকর। তাঁর লেখা দিয়ে তৈরি করে ফেলেন এক ম্যাজিক-পৃথিবী। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রকে বাদ দিলে যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ।বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর বাংলার পাঠক সমাজকে নিজের কলমের জাদুতে এক রকম মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। যাদুকর যেমন তার হাতে থাকা ছড়ি বা লাঠি ঘুরিয়ে দর্শকদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, হুমায়ূন আহমেদও তেমনি নিজের হাতে থাকা কলমটি সাদা কাগজের উপর বুলিয়ে আমাদের বারবার অন্য জগতে নিয়ে গেছেন। তিনি একাধারে উপন্যাস লিখেছেন, ছোটগল্প লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন এবং গানও। প্রথম উপন্যাসেই পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেওয়া লেখক গোটা পৃথিবীতেই বিরল। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এই বিরল প্রজাতির সাহিত্যিকদের একজন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস "নন্দিত নরকে" প্রকাশিত হলে সেটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি তাঁর জীবনকালে দুশোটিরও বেশি বই রচনা করেছিলেন। মজার বিষয় তাঁর সব বইই বাংলাদেশের বেস্ট সেলার বা, সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া গ্রামের কুতুবপুর উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর পারিবারিক ডাক নাম ছিল কাজল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰী লাভ করে প্রথমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের রসায়ন বিভাগেই অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার সায়েন্সেও পিএইচডি করেছিলেন এই কালজয়ী লেখক। পরবর্তী সময়ে এই কলমের যাদুকর লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অধ্যাপনা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। যদিও শিক্ষক হিসেবেও নিজের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাসের নাম "নন্দিত নরকে"। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ "শঙ্খনীল কারাগার"। তিনি বাংলা উপন্যাসে সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারা নিয়ে এসেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে দেখিয়েছিলেন নতুন দিক। তাঁর সৃষ্ট দুটি চরিত্র হিমু এবং মিসির আলিও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস হল "জোছনা ও জননীর গল্প", আমার আছে জল, নীল মানুষ, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, আগুনের পরশমণি.... এবং আরো আরো অনেক।
বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন রচনাশৈলীর জনক। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের এক কালজয়ী নক্ষত্র তিনি। যখন গল্প লিখেছেন মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন, যখন তাঁর কলম থেকে উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তখনও তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। নাটক নির্মাণ করেছেন মানুষ সেখানেও ভালবেসে দেখতে এসেছেন চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন সেখানেও মানুষ ভালবেসে সিনেমা হল কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে। যখন যেখানে কলম চালিয়েছেন, নিজের সোনালী হাতের স্পর্শ দিয়েছেন, সেটাই বাংলার মানুষ গ্রহণ করেছে পরম মমতায়, পরম ভালবাসায়। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে নিউইয়র্কে কালজয়ী এই সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।