জগদ্ধাত্রী পুজোর সন্ধেয় সেবার দীনেশচন্দ্র সেনের নেমন্তন্ন ছিল কলকাতার ডাক্তার চন্দ্রশেখর কালী-র বাড়িতে। খুব ধুমধাম করে পুজো হয় সেখানে। অনেক লোক অতিথি। ফলে, গল্প-আড্ডা-তর্কে বাড়ি যেন একেবারে গুলজার। তারই মধ্যে এসে দাঁড়ালেন দীনেশ। দেখলেন, সব অপরিচিত মুখ। একমাত্র ডাক্তার ছাড়া তিনি কাউকে চেনেন না, তাঁকেও কেউ না। কাছেপিঠে ডাক্তারকে কোথাও দেখতে পেলেন না। কিন্তু, পাশেই দেখলেন একদল শিক্ষিত যুবক বাংলা সাহিত্য নিয়ে বেড়ে আসর জমিয়েছে। এক কলেজ পড়ুয়া ছোকরা বক্তা, বাকিরাও কলেজ পড়ুয়া, সম্ভবত জুনিয়ার, তারা বক্তার কথা হাঁ করে গিলছে। বিষয়, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য। ফলে, দীনেশের আগ্রহ হল। তিনি দাঁড়ালেন।
সুতরাং, দীনেশ দূর-স্রোতা হলেন। কিন্তু বক্তা যখন আসর জমিয়ে আবেশগ্রস্ত, নিকট-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ; ঠিক তখনই ভ্রু কোঁচকালো দীনেশের, হঠাৎ বক্তৃতার মাঝে বক্তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, 'আপনি ভুল বলছেন!' তীব্র ঝাঁকুনিতে গাড়ি ব্রেক কষলে ঘুমন্ত যাত্রী জেগে যেমন বিহ্বল হয়ে যায়, তেমনি বক্তা ও শ্রোতা আগন্তুক দীনেশের বাধায় বিহ্বল হয়ে গেলেন। সম্বিৎ ফিরতে লাগল কয়েক মুহূর্ত। তখন বক্তারও ভুরু কোঁচকালো। তিনি বললেন, 'ভুল! কেন, কী ভুল বললাম!' দীনেশ স্মিত হেসে বললেন, 'একটা নয়, অনেক ভুল।' এবার বক্তা রণংদেহী, 'বেশ, কী ভুল বলেছি দেখিয়ে দিন!' দীনেশ তখন বক্তার বক্তব্য ধরে ধরে ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, সে-সব শুধরেও দিলেন।
কিন্তু, কে শোনে কার কথা। শ্রোতা ও বক্তা একযোগে তেরিয়া হয়ে উঠল। বক্তা বলল, 'বললেই হল! আমি যে-সব কথা বলেছি, সে-সব কোত্থেকে বলেছি জানেন? দীনেশবাবুর 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' বই থেকে! আপনি বোধহয় সে বই পড়েননি, নইলে এসব কথা বলতে আসতেন না!' দীনেশ মৃদু হেসে বললেন, 'সে বই যখন লেখা হয়েছে তারপর সাহিত্য ও ইতিহাসের অনেক নতুন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। সে-সব তত্ত্বের আলোয় বইটির সংশোধন দরকার।' বলে কী লোকটা! ছিটেল, না পাগল! লোকটার কথায় হাসবে, না উপেক্ষা করবে ভেবে পেল না সমবেত বক্তা ও শ্রোতারা। তারই মধ্যে একজন বলেই বসল, 'মশাই, দীনেশবাবুর বইটিতে প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে শেষ কথা বলা হয়েছে। এই বইটিই এখন 'অথরিটি'। আর আপনি সেই বই সংশোধনের কথা বলছেন!'
হুট করে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়া লোকটাকে সকলে মিলে উপেক্ষা করার উদযোগ করতেই মূর্তিমান রসাভাষের মতো হাজির হলেন স্বয়ং ডাক্তার চন্দ্রশেখর। শুধু হাজির নয়, এলেন একেবারে হাঁ হাঁ করে, 'আরে এই যে দীনেশ কখন এলে?' বলে উত্তরের অপেক্ষা না-করেই এক নিঃশ্বাসে শ্রোতা এবং বক্তা উভয়ের দিকে ফিরে বললেন, 'তোমরা বোধহয় এঁকে চেন না, না? ইনিই হলেন বিখ্যাত 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' বইয়ের লেখক দীনেশচন্দ্র সেন।' তাই শুনে বক্তা ও শ্রোতামণ্ডলী আর একবার হঠাৎ হতভম্ব হলেন। এবং, তাঁদের 'হাঁ'-মুখ বন্ধ হওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল!
দীনেশচন্দ্র সেন মানুষ হিসেবে এমনই ছিলেন। ব্যক্তিগতজীবনে নিজের ভুলের জন্য যেমন সর্বদা নিজের সমালোচনা করতেন; তেমনি সাহিত্য ও গবেষণামূলক রচনার ক্ষেত্রেও বার বার নিজের ভুল শুধরেছেন, নিজের সমালোচনাও করেছেন। কখনই নিজেকে ছেড়ে কথা বলেননি।
তিনি, বিশ্লেষণমুখী সাহিত্য ও সমালোচনার যে ধারাটি আজও বহমান, তার পূর্বসূরি। আমরা অবশ্য তাঁর সেই কৃতিত্ব সেভাবে মনে রাখিনি। তিনি প্রতিভাশালী বহুমুখী কৃতীজন। তবু তাঁর অন্যান্য ক্ষেত্রের কৃতিত্ব আমরা একেবারেই মনে রাখিনি। তিনি বাল্যে কবিতা লিখতেন, তাঁর সেই কবিসত্তাকে আমরা মনে রাখিনি; তিনি ছোটগল্প লিখেছেন, আমরা মনে রাখিনি; তিনি দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে বনজঙ্গল পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ থেকে উদ্ধার করেছেন বহু দুর্মূল্য পুঁথি, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আমরা মনে রাখিনি; তিনি ছিলেন বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য এবং ইতিহাসে সুপণ্ডিত, অসাধারণ শিক্ষক; আমরা মনে রাখিনি। তিনি বাঙালির সমাজ ও সাহিত্য নিয়ে রচনা করেছিলেন বৃহত্তম দুটি ইতিহাসগ্রন্থ-দু'খণ্ডে 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' এবং দু'খণ্ডে 'বৃহৎ বঙ্গ'; আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাঁর এই দুটি অসামান্য কীর্তি ভুলতে। পারিনি। আমরা তাঁর ঢঙেই বলেছি, তাঁর তথ্য সেকেলে, নতুন তথ্যের আলোয় সেগুলোর অনেক ক'টিই অচল। তবুও ভুলতে পারিনি। আসলে, 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য'- প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নগেন্দ্রনাথ বসুর মতো মনীষীরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন প্রিয় গ্রন্থটির লেখককে। কারণ, দীনেশচন্দ্রের আগে বাঙালির সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে এত গভীরভাবে কেউ ভাবেননি, অনুসন্ধান করেননি, বিশ্লেষণ করেননি, অমন সুললিত ভাষায় লেখেননি। তাই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আলোচনায় সেদিন যেমন দীনেশচন্দ্র সেন অপরিহার্য ছিলেন, তেমনি আজও অপরিহার্য রয়ে গেছেন।
তথ্যঋণ : 'ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য'- দীনেশচন্দ্র সেন।