তিনি যে সময়ের মানুষ সে সময় মেয়েদের বিজ্ঞান পড়াটাকেই অন্যরকম নজরে দেখা হত। পছন্দের কেরিয়ার বা পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগও কম। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। সেই প্রতিকূল পরিবেশে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণার পরিসরে প্রবেশ করেন।
তিনি অসীমা চট্টোপাধ্যায়। ভারতের প্রথম মহিলা রসায়নবিদ। রসায়ন গবেষণার ক্ষেত্রে এই বাঙালিনীকে গোটা বিশ্ব চিনত। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাস্টার’।
তাঁর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু একবার বলেছিলেন বিজ্ঞান পাঠ এবং গবেষনার ক্ষেত্রে নারীদের যে অবমূল্যায়ন করা হয় অসীমা সেই ধারণার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ।
জন্ম ১৯১৭-র ২৩ সেপ্টেম্বর। কলকাতা শহরে। বাবা ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়।মা কমলা দেবী। তিনি দ্বিতীয় সন্তান। ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। অধ্যাপনা করতেন বঙ্গবাসী কলেজে।
মধ্যবিত্ত পরিবার। পড়াশোনায় উৎসাহ পেতেন পরিবার থেকে। বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে জৈব রসায়ন বিদ্যায় স্নাতক হন।
১৯৩৮- এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করেন। স্নাতকোত্তরের পরীক্ষাতে তিনি সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে দ্বিতীয় হন। দেশে তিনিই প্রথম মহিলা যিনি বিজ্ঞানে ডক্টরেট হন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অধ্যাপনা শুরু করেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁকে সহায়তা করতেন। বাল্যে পিতৃহীন অসীমা চট্টোপাধ্যায়কে কন্যার স্নেহ করতেন।
১৯৪০-এ লেডি ব্রাবর্ণ কলেজে শুরু হয় রসায়ন বিভাগ। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
শুরুর দিকে বাবার মতই ভেষজ উদ্ভিদে আগ্রহ ছিল তাঁর। ছোটবেলায় হুগলীতে গ্রামের বাড়িতে। সাধারণ গাছ-গাছড়ার যে কী অসাধারণ ঔষধীগুণ থাকতে পারে তা তিনি প্রাথমিক ভাবে জেনেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকেই। বাল্যের পাঠ মনে গেঁথে গিয়েছিল। গবেষনার বিষয় হিসেবেও ভেষজ উদ্ভিদকেই বেছে নিয়েছিলেন। ওই সব উদ্ভিদের ভেষজ ও রাসায়নিক গুণ তিনি গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করেন। উদ্ভিদ রসায়ন এবং কৃত্রিম জৈব রসায়ন ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়।
উইনসনটিন, ম্যাডিসন, ক্যালটেক এবং জুরখ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করেছিলেন। নোবেলজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী পল কারোর সঙ্গেও কাজ করেছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ভিনকা অ্যালকালয়েড মেডিসিন আবিষ্কার করেন। যার উৎস নয়নতারা গাছ। এই প্রতিষেধক ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা। কেমোথেরাপিতে ব্যবহার হয়।
তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এপিলেপ্সি অর্থাৎ মৃগী রোগের ভেষজ প্রতিষেধক আবিষ্কার। কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া রোধী ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নতুন আলো দেখিয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানকে।
ভারতীয় বনৌষদি নামে ছয় খণ্ডের একটি গবেষণাধর্মী একটি বইও লিখেছিলেন ।
অসীমা চট্টোপাধ্যায় সত্যেশচন্দ্র পাকড়াশির সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেন ‘দ্য ট্রিটিজ অব ইন্ডিয়ান মেডিসিন্যাল প্ল্যান্টস ’ শীর্ষক গ্রন্থ৷
১৯৬০ সালে ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সেস ইন ইন্ডিয়া’র ফেলো নির্বাচিত হন। ভারতে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পান রসায়ন গবেষণায় তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য। ভারত সরকার তাঁকে ‘ পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৭৫- এ ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রায় ৪০০ টিরও বেশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নাল প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর।
বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকেও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাঁর কাজ। তাঁরই প্রচেষ্টায় সল্টলেকে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদ গবেষণা কেন্দ্র৷
২০০৬ সালে ২২ নভেম্বর তিনি প্রয়াত হন।