বিবাহ পরবর্তী জীবন তাঁকে সব দিক থেকে বদলে দিয়েছিল। ধার্মিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। তিনি ভারতরত্ন অরুণা গাঙ্গুলি। বিবাহ পরবর্তী জীবনে অরুণা আসফ আলি।
স্কুল শিক্ষিকা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন এবং একের পর এক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সহিংস করে তুলেছিলেন তিনিই। ইংরেজদের নাকানিচোপানি খাইয়ে ছেড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ইংরেজ সরকার বাগে পেতে ব্যর্থ হয়।
১৯২৮ সালের আগে পর্যন্ত আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই চলছিল তাঁর জীবন। পড়াশোনা লাহোরের স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্টে। নৈনিতালে আল সেইন্টস কলেজ থেকে পাশ করার পর শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে আসেন কলকাতায় গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। ছুটিতে নৈনিতাল গিয়ে পরিচয় হয় ব্যারিস্টার আসফ আলির সঙ্গে। তিনি আবার ভগত সিংয়ের ফাঁসির মামলা লড়ছিলেন। পরিচয় থেকে প্রেম এবং ২২ বছরের বড় ব্যক্তিকে বিবাহ। জীবন বদলে যায় অরুণা গাঙ্গুলীর।
সক্রিয়ভাবে যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। প্রথম কারাবন্দী হন লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে। ১৯৩১ সালে গান্ধী আরউইন চুক্তিতে সবাই ছাড়া পেলেও অরুণাকে ছাড়া হয়নি। অন্যান্য মহিলা জেলবন্দীরাও তখন তার মুক্তির দাবিতে জেল ছাড়তে অস্বীকার করেন। গান্ধীজির হস্তক্ষেপে শেষমেশ ছাড়া পান। ১৯৩২ সালে আবার তাকে গ্রেফতার করে তিহার জেলে রাখা হয়। জেলে স্বদেশী কারাবন্দীদের দুঃসহ অবস্থা দেখে শুরু করেন আমরণ অনশন। দশদিন পর কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে তার দাবি মেনে নেয়। জেলের পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অম্বালা জেলে। রাখা হয় নির্জন সেলে। ছাড়া পাবার পর সক্রিয় রাজনীতিতে না থেকে পড়াশোনা ও লেখালেখি নিয়ে থাকতেন।
এরপর ১৯৪২, মহাত্মা গান্ধী দেশ জুড়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন। গ্রেফতার হলেন নেহরু প্যাটেল, আসফ আলি সহ সব প্রথম সারির নেতা। ৯ আগস্ট, তৎকালীন বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ময়দানে বিশাল জলের ট্যাঙ্কের ওপর থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে অরুনা তেরঙ্গা উড়িয়ে সূচনা করেন এক অন্যরকম আন্দোলনের, যা মোটেও অহিংস ছিল না। তাঁর ও রামমনোহর লোহিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা বহু জায়গায় রেললাইন তুলে ফেলে, উপড়ে দেয় টেলিগ্রাফ পোস্ট। আগুন লাগিয়ে দেন সরকারি অফিস আদালতে, এমনকি থানাতেও। গ্রেফতার এড়াতে চলে যান গোপন আস্তানায় এবং সেখান থেকেই পরিচালনা করতে থাকেন আগস্ট আন্দোলন। পুলিশ তার বাড়ি ও সম্পতি বাজেয়াপ্ত করে নিলাম করে দেয়। ফেরার ঘোষণা করে তাঁকে।
১৯৪৪ সালে গোপন ডেরা থেকে প্রকাশ করেন “ইনকিলাব” নামে এক পত্রিকা, দেশের তরুণদের আহ্বান জানান এক সর্বাত্মক বিপ্লবের। বোম্বাই ডকের নৌবিদ্রোহকে খোলাখুলি সমর্থন জানান ঐ পত্রিকায়। পাঁচ হাজার টাকা মাথার দাম ঘোষণা করে বৃটিশ সরকার। মাঝে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, গান্ধীজি চিঠি লিখে অনুরোধ করেন আত্মসমর্পণ করতে। মানেননি সেই নির্দেশ, ১৯৪৬ সালে তাঁর মাথার ওপর থেকে পরোয়ানা উঠে গেলে তখনই তিনি প্রকাশ্যে আসেন।
স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের সাথে তাঁর দুরত্ব বাড়ে। যোগ দেন রামমনোহর লোহিয়ার সোস্যালিস্ট পার্টিতে এবং ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে। ষাটের দশকের পর থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি। দেশ বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৬৫তে পান লেনিন শান্তি পুরস্কার, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার ওপর সোভিয়েত দেশ নেহেরু পদক। ভারত সরকার ১৯৯২ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষন সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৯৭ এ পান মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মান। ২৯শে জুলাই ১৯৯৬, দিল্লিতেই পরলোক গমন করেন।