“বড্ড ছোট আমার ঘর। এখানে আমার প্রিয়দের আমি ধরাই কী করে? কতরকম কায়দা করি, কিন্তু কোন সুরাহা হয়না। হওয়ার কথাও নয়”।
কথার ভাষায় কবিতা তাঁর ধরণ। আটপৌরে শব্দগুলো চলতে চলতে যেখানে এসে থেমে যায়, সেখানেই জন্ম হয় বোধির। মানুষের কথা, সুখ-দুঃখ, প্রকৃতি কিংবা পরবাস অন্য দিশা দেখায়। পাঠকের মনে হয় সারাদিন ধরে যা খুঁজছিলাম তাই যেন ধরা দিল দু’ পংক্তির মাঝখানে। চলন থমকে যায় শব্দের কাছে।
এমন ছিল অরুণ মিত্রের কলম। চল্লিশের দশকে বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কবি। বাংলা সাহিত্যে তিনি এক সেতু। অনুবাদ সাহিত্যের একটি পর্ব। যিনি কবিতা দিয়েই পাঠকের কাছে ভুবনের দ্বার খুলেছিলেন। ফরাসী সৌরভে ভরে উঠেছিল কবিতা পাঠকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ঘর খানা।
অরুণ মিত্র অন্যরকম রোদ এনেছিলেন সে ঘরে। মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের ভাঙ্গাগড়ার সঙ্গে মিলেছিল মাটির টান। একাকার হয়ে গিয়েছিল যশোর আর কলকাতা।
তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের যশোর। ১৯০৯ সালের ২ নভেম্বর। বাবা হিরালাল মিত্র। মা যামিনীবালা। ছয় পুত্রকন্যার মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ সন্তান।
যশোরে পৈত্রিক বাড়ি আর মামা বাড়ি ঘিরেই তাঁর ছোটবেলা। খুব ছোটবেলায় চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু মামা বাড়ির টান ছিল অমোঘ। বারবার ছুটে যেতেন।
ভর্তি ঘর, গ্রামাফোন, গানের রেকর্ড, সাহিত্য পত্রিকা- সব মিলিয়ে ভীষণ টানের জায়গা ছিল মামা বাড়ি। ছুটি পেলেই ছুটে যেতেন সেখানে। বাড়িতে সব ধরনের মানুষরা আসত। বিশেষ করে তরুণরা। আসতেন ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কিশোর অরুণের কাছে সেই মানুষটির টানও মামাবাড়ি থেকে কিছু কম নয়। লেখার জগতের প্রতি আগ্রহ শুরু হল সেখান থেকেই।
প্রথম কবিতা ষোল বছর বয়সে। 'বেণু' নামে একটি কিশোর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই লেখা। তবে সে বয়সে তাঁকে অনেক বেশি টানত গান।
নিজের লেখা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
মানুষ ও অন্য প্রাণীর সংস্পর্শ যখন ভেতর থেকে আমাকে নাড়ায় কিম্বা যখন কোনো নিসর্গদৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করে, তখন আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়। লিখিও প্রায়ই। তবে আমার পৃথিবী মনুষ্যকেন্দ্রিক। আমার দৃষ্টিকে সবচেয়ে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে মানুষ, তার অস্তিত্ব তার জীবন তার আচরণ। এবং মানুষ হিসেবে অবস্থান থেকেই আমার যা কিছু দেখা, যা কিছু বলা।
কবিতাকে ‘মুখের ভাষায়’ প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। গদ্য হয়েছিল কবিতা, কবিতা হয়েছিল গদ্য। আটপৌরে ভাশা আর দেশজ শব্দে তুলে ধরেছিলেন সময়কে। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বোধ এবং দর্শন প্রতিফলিত হত কবিতায়। কলম তখন আর শুধু কলম থাকেনি, হয়ে উঠেছিল হাতিয়ার। স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তাল সময়ে মানুষের সংগ্রামই হয়ে উঠেছিল কবিতাঁর চালচিত্র।
“কুঁড়ে ঘরে কোন্ কান্না শুনেছিলাম
সন্ধ্যায় বা শেষরাতে
মজা গাঙের ধারে সরসর হাওয়ায়
তা যেন কোলকাতার কোলে মুখ গুঁজে ফোঁপায়;
শূন্য হাহুতাশ”
সহজ সারল্যে প্রতিষ্ঠা করা নয়, কবিতার ভাষাকে একেবারে মুখের কাছাকাছি নিয়ে আসাই ছিল কবি অরুণ মিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। এই কারণে গদ্যকবিতার শৈলী নির্মাণে ‘তিনি ব্যবহার করেছেন আটপৌরে’ শব্দ, দেশজ ভাষা ও শব্দগুচ্ছ।
বাংলা কবিতায় ফরাসী ধরন তিনি প্রয়োগ করে ছিলেন। ফরাসী কবিতার মূল বিষয়ও হল ‘নিজেকে প্রকাশ’।
ভিক্টর হুগোর উপন্যাস পড়ে তিনি ফরাসী ভাষাও কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী হন। একেবারে বুঁদ হয়ে যান। সংবাদপত্র, পত্রিকার চাকরী সেসব ছাড়িয়ে জীবন বাঁক নেয় একেবারে অন্য দিকে।
ফরাসি সরকারের আহ্বানে ১৮৪৮ সালে বৃত্তি নিয়ে গবেষণার কাজে ফ্রান্স যাত্রা করেন। প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর গবেষণার জন্য ডক্টরেট। তাঁর পড়াশোনাও ফরাসী হাসিত্য নিয়েই। ১৯৫২ সালে দেশে ফিরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন। অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত সেখানেই।
বাংলা ফরাসী অনুবাদ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অরুণ মিত্র প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কবিতা দিয়েই যদি তাঁকে পুরোটা মাপা হয় তাহলে বনস্পতির মতো মানুষটির অনেকখানি দিক অনালোকিত থেকে যায়। প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রেই তিনি আবিষ্কার। বিভিন্ন ফরাসী লেখকের প্রবন্ধের অনুবাদ। এছাড়া ফরাসী সাহিত্য নিয়ে মৌলিক প্রবন্ধ। ফরাসী ও বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক। সে গদ্য শুষ্কং কাষ্ঠং নয়, বরং হালকা মেজাজের কৌতুক যোগ হয়েছে সিরিয়াস বিষয়েও। ব্যক্তিগত অনুভব থেক উঠে আসা ভাষা প্রবন্ধেকেও অন্যরকম ফর্ম দিয়েছে।
আমার ছটফটানি থামাতে পারিনা।
টেবিলের উপর আমার প্রার্থনার হাত –
অক্ষর দাও অক্ষর দাও
সাতরঙা পৃথিবীর মুখ চেয়ে আমি এক ভিখিরি,
দয়া করো ।
চেয়েছিলেন শব্দে শব্দে বেঁচে থাকতে। পদ্যে, গদ্যে আগোলহীন ভাবে। শব্দের ঈশ্বরীর কাছে অক্ষর ছাড়া আর কোনও আকাঙ্খা রাখেননি। মাঝখানে জীবনের সমুদ্র সফেন। ডুব সাঁতারে মগ্ন এক কবি। কাগজ কলম আর প্রজ্ঞায় স্থির...