"তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প ক তেমনি করেই লেখো।'
তিনি ভেবেছিলেন লেখা তাঁর দ্বারা কস্মিনকালেও হবে না।
সাহস যুগিয়েছিলেন রবিকাকা। ভাইপোকে বলেছিলেন, "আমি তো আছিই..."
রবিকাকার কথায় সাহস পেয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। শকুন্তলার গল্প।
লেখা শেষ হতে নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। একটা শব্দও কাটতে পারেননি তিনি।
লিখিয়ের নাম অবন ঠাকুর। বইয়ের পাতায় অবনীন্দ্রনাথ। রবিকাকার 'অবন পাগলা'।
প্রথম বইয়েই তাঁর কাছে এমন ছাড়পত্র পেয়ে প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন। খুব জোর এসেছিল মনে।
অবনীন্দ্রনাথের কথায়, 'সেই প্রথম জানলুম, আমার বাংলা বই লেখার ক্ষমতা আছে।'
এভাবেই বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে হাত খুলে গিয়েছিল লেখার। জোর কদমে লিখতে শুরু করলেন। একের পর এক। ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, নালক, বুড়ো আংলা...আরও বহু
ছোটদের জন্য লিখতেন। বড়দের লেখাও এমন যে বুঝতে পারবে ছোটরা। নিজের লেখায় বারবার বলেছেন তাঁর কলম সহজদের জন্য। ছোটরাই তাঁর পাঠক।
অবন ঠাকুরের বই আসলে পাতায় পাতায় ক্যানভাস। সেখান থেকে ঝলকে আসে রঙ। দু চোখ ভরে রঙ দেখতেন। রঙ খুজঁতেন। সাদা জায়গায় রূপ পেত তারা। কখনও ছবি বা কখনও হয়ে উঠত অক্ষর।
"... মনোহর সিং বুড়ো দারোয়ান-
মস্ত লম্বা চওড়া, ফরসা গায়ের রঙ, ধবধব করছে সাদা দাড়ি। ...তার গলায় মোটা মোটা আমড়ার আঁটির মতো সোনার কাঠি, হাতে বালা, কোমরে গোঁজা বাঁকা ভোজালি, সে ছিল দেউড়ির শোভা।"
অবনীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে পড়তে চোখ আপনা আপনি ছবি আঁকতে শুরু করে। সে ছবি নিছক ছবি নয়, তার প্রাণ আছে। শ্বাস নেয়। মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। বদলাতে শুরু করে মন।
সহজিয়া জীবনের রসে।
অতুল ঐশ্বর্য নিয়ে অপেক্ষা করে বইয়ের পাতা। এমন মায়া রঙিন শব্দ, কোনও জটিল তত্ত্বের দারোয়ান সেখানে নেই।
আড়ম্বরহীন উদার ভাবখানা তাঁর শিল্প এবং সাহিত্যের দর্শন।
জীবনের কথা, মুখের ভাষায় তুলে আনতেন। ঠিক যেমনটা দেখতেন তেমনটাই।
আত্মজীবনীর পাতায় জীবনের সায়নপর্বে লিখেছেন, একবার চশমার একটা কাচ ভেঙে গেল। তাই তিনি খালি চোখেই দেখা শুরু করলেন। কাছের মানুষদের বললেন, "ভালই হয়েছে। শার্শির ফাঁক দিয়ে রঙ আসবে"।
একদিন ছাত্র নন্দলাল বসু এলেন তাঁর কাছে। তাঁকে অবনীন্দ্রনাথ বললেন, "দেখো তো আমার এই চশমাটা চোখে দিয়ে।"
ছাত্র তো সেই চশমা দেখেই অবাক!
বললেন, "এ যে রামধনুকের মতো দেখা যায়। অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি বুঝি কাচ?"
অবন ঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন, ছবিতে যত রঙ তিনি দেন সেই রঙ লেগে আছে রাস্তায়।
কোন রাস্তায়?
তাঁর বাড়ির লাগোয়া। বারান্দার পাশে। লাল সুরকির রাস্তায়।
ফাঁকা রাস্তায় বাতাস বয়। লাল ধূলো ছিটিয়ে দেয় গাছের ওপর। লাল রঙা গাছ। ফের কয়েক মুহূর্তে সবুজ। যেন লাল বৃষ্টি হয়ে গেল।
সে ছবি ক্যানভাসে ধরার স্বপ্ন দেখতেন। তা যদি নাও হয় তাই ধরে রেখেছিলেন অক্ষরে, খাতায়। কলম-কাগজের ক্যানভাসে।
যে ছবি আঁকা হয়ে ওঠেনি সেই স্মৃতি এঁকেছেন কলমে। জীবন ব্যাপি।
কালি কলম মন
লেখে তিনজন।
'ছবিটি আঁকি। তুলিটি জলে ডোবাই। রঙ ডোবাই। মনে ডোবাই। তবে লিখি ছবিটি। সেই ছবি হয় মাস্টারপিস'।
তাঁর লেখাও সেই পথেই চলেছে। শুধু তুলির বদলে হাতে উঠেছে কলম...
তথ্য ঋণ: জোড়াসাঁকোর ধারে
অবনীন্দ্র রচনাবলী